ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুজিবনগর সরকার

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুজিবনগর সরকার

২৫ মার্চ ’৭১। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালী জাতি ও বাঙালী সেনা-অফিসার, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। শুরু হয় জনযুদ্ধ। প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। অপরিহার্য ছিল সরকার প্রতিষ্ঠার। পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবেশী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেন। মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পর টনক নড়ে হানাদার বাহিনীর। তারা তৎকালীন কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ২১ ও ২৩ এপ্রিল এবং পরে আরও কয়েকবার পাকিস্তানী বাহিনী সেখানকার ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার। ৩১ মার্চ ১৯৭১ ভারতের লোকসভা ও রাজ্য সভায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। দিল্লীতে ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারী বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক উপকরণ, সহযোগিতা ও সংশ্লিষ্ট সাহায্যাদি প্রয়োজন। পিএন হাকসার, কে রুস্তমজী, গোলক মজুমদার প্রমুখ উচ্চপদস্থ ব্যক্তি সরকার গঠন প্রসঙ্গে তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান। সে জন্য তাজউদ্দীন সরকার গঠনের বিষয়ে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর তাজউদ্দীন আহমদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। ২৬ মার্চেই শেখ মুজিব হাইকমান্ডারদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন বলে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মুজিবনগরে স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।’ ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রীরূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক’ এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করবেন। নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, করারোপ, অর্থ ব্যয় এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ঘোষণায় জাতিসংঘ সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। এই ঘোষণাকে কার্যকর করার জন্য ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার মুক্তাঞ্চলে এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চলে কলকাতা থেকে। শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই অস্থাায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিাত সাংবাদিকদের সামনে এই স্থানটিকে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী মুজিবনগর হিসেবে উল্লেখ করায় বিশ্বব্যাপী এটি মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার নিজেকে কখনই প্রবাসী হিসেবে স্বীকার করেনি। শপথ অনুষ্ঠানের পরে ভারত সরকারের স্বীকৃতি চেয়ে অস্থাায়ী রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে পত্র এবং সংশ্লিষ্ট আইনানুগ দলিলাদি প্রেরণ করেন, তার ঠিকানা ছিল মুজিবনগর। এ কথা আজ প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পূর্বেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত হয়, সেসব দেশের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতা অনিবার্য হয়ে পড়ে। সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৪ অক্টোবর লন্ডন গমন করেন। লন্ডনে তাঁর কার্যক্রম তিনটি দিক থেকে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূণ। প্রথমত লন্ডনে প্রবাসী বাঙালী, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাজ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামোয় শক্তিশালীকরণ। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাধা সৃষ্টি করলে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা। এ সময় ভারত সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। সত্তরের নির্বাচনের আগেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিনিধিকে ভারত পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ডাক্তার আবু হেনাকে ভারতে পাঠান। লক্ষ্য করা যায়, সীমান্ত অতিক্রম করার পরেই ভারত সরকারের সহযোগিতায় মুজিবনগর সরকার গঠন যেমন দ্রুত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও যুদ্ধ সরঞ্জাম ইত্যাদি প্রাপ্তি এবং রেডিও সম্প্রচারও দ্রুত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বরাবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি পত্র লেখেন। পত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘দীর্ঘ ১১ দিন ঢাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানের অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রেখে একটি শাসনতান্ত্রিক সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। একটি দেশপ্রেমহীন গোষ্ঠীর জন্য এই প্রচেষ্টা ট্র্যাজিক পরিস্থিাতির দিকে ধাবিত করে। বর্তমান সঙ্কট যে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এ কথাটি যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তাতে আমি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ।’ পত্রের শেষাংশে ইয়াহিয়া খান উল্লেখ করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’ ওই দিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রেরিত একটি পত্রে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন সম্পর্কে বলা হয়, ‘ভারত তার ভূখ-ে অস্থায়ী সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে এবং অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা তাদের সরকারকে সহযোগিতার জন্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যাদের ইতোমধ্যেই পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’ এই অবস্থায় সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের মিটিং অনুষ্ঠিত হয় ১৯ এপ্রিল বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে। হেনরি কিসিঞ্জার মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন। সভায় পরিস্থিতি পর্যালোচনায় হেনরি কিসিঞ্জারের প্রশ্নের জবাবে সিআইএ প্রধান লে. জেনারেল রবার্ট কুশমান বলেন, ‘কুষ্টিয়ার নিকট চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে তারা ইতোমধ্যেই শেখ মুজিবকে প্রধান করে সরকার গঠন করেছে। ভারত আপাতদৃষ্টিতে সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি ভাবছে; কিন্তু ওই সরকারের দখলে কোন ভূখ- নেই।’ সিআইএ প্রধান বলেন, ‘এই সরকারের স্বীকৃতি সম্পর্কে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে; যদিও সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ‘ব্যাপক রক্তপাত’ যা তারা ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছে, এর নিন্দা এবং অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন, ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।’ কিসিঞ্জার বলেন, ‘স্বীকৃতির প্রশ্নই আসে না। তবে একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, ৩০ হাজার সৈন্য যতই শক্তিশালী হোক না কেন ৭৫ মিলিয়ন লোককে তারা কিভাবে পদানত রাখবে, যদি না তাদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করা না যায়!’ আন্তর্জাতিকভাবে বিভাজিত পরাশক্তির ঘূর্ণাবতের মধ্যেও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখেই মুজিবনগর সরকার এগিয়ে যায়। আদর্শিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা।’ স্বাধীনতার সনদ ছিল জেনেসিস অব দ্য কনস্টিটিউশন। এই সনদকে সামনে রেখেই ১০ এপ্রিল সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে হাজারো জনগণের মাঝে প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে স্বাধীনতা সনদের কয়েকটি মূল লক্ষ্য ও আদর্শ বেরিয়ে আসবে- স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ, গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা ও সামরিক বাহিনীকে জোরদার করা, কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং পাকিস্তানে কর্তব্যরত কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্যে নিয়ে আসা, জনগণের সরকার গঠন কাঠামোতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের আস্থা গ্রহণ এবং দায়িত্ব প্রদান, সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবেলা করে বন্দী মুজিবের মুক্তি ত্বরান্বিত করা। এই লক্ষ্যে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ অবরোধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল বলেই শত চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে লাখো শহীদের রক্তের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। লেখক : গবেষক [email protected]
×