ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৫০ বছরে পঞ্চাশ জাতীয় কর্মসূচী আসছেন একাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ভারত রাশিয়ার ওয়ার ভেটেরানদের আমন্ত্রণ ১৮ দেশে মৈত্রী দিবস

সৃষ্টি হবে নবজাগরণ ॥ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদয়াপনে বর্ণিল আয়োজন

প্রকাশিত: ২২:২৭, ১ ডিসেম্বর ২০২১

সৃষ্টি হবে নবজাগরণ ॥ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদয়াপনে বর্ণিল আয়োজন

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের ৫০ বছর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। মহা এই উপলক্ষ উদ্যাপনে বিপুল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। বিজয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত স্মরণে সরকারীভাবে নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। একই সময় বাংলাদেশ ও একাত্তরের মিত্রশক্তি ভারত যৌথভাবে ১৮ দেশের রাজধানীতে অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। বর্ণিল আয়োজনে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নব জাগরণের সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিজয় দিবস সামনে রেখে ইতোমধ্যে জাতীয় কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। কমিটির পাশাপাশি কাজ করছে আরও বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সমস্ত আয়োজনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জানা গেছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫০টি জাতীয় কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ সব কর্মসূচীর আওতায় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মহাসমাবেশ আয়োজন করা হবে। ৫০টি জাতীয় পতাকাসহ সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ণিল শোভাযাত্রা দেশের ৬৪ জেলা প্রদক্ষিণ করবে। যুদ্ধজয়ী জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত শুভেচ্ছা বাণী পাঠানো হবে। গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হবে। জাতীয় সংসদ, হাতিরঝিল ও অন্যান্য স্থানে নির্ধারিত দিনে থাকবে ‘লাইট এ্যান্ড লেজার শো।’ কমিটি সূত্রে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিশেষ কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হবে। সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণিল কুচকাওয়াজে সশরীরে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। চলন্ত যান্ত্রিক সামরিক কন্টিনজেন্টের সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন তিনি। কুচকাওয়াজে অংশ নেবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যা ব, আনসার ও ভিডিপি এবং কারারক্ষীদের আলাদা আলাদা দল। থাকবে বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাই-পাস্ট ও আকর্ষণীয় এ্যারোবেটিক এয়ার শো। সমান আকর্ষণীয় হবে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় হেলিকপ্টার থেকে রজ্জু বেয়ে অবতরণ ও প্যারাস্যুট জাম্প। সূত্র জানায়, এবারের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিতে ঢাকা আসবে ভারত ভুটান রাশিয়া ও মেক্সিকোর প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোচ্চ সহায়তাকারী দেশ হিসেবে ভারত, রাশিয়া এবং বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ হিসেবে ভুটান এবং মেক্সিকোকে এ ঐতিহাসিক কুচকাওয়াজে অংশ নেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। বাংলাদেশের নৌ-প্রধানের ভারত সফরের সময়েই স্থির হয়েছিল, ঢাকায় এবারের বিজয় দিবসের উদ্যাপনে যোগ দিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল ও সামরিক ব্যান্ড বাংলাদেশে আসবে। বিজয় দিবসের কর্মসূচীতে ভারত ও রাশিয়ার ওয়ার ভেটেরানদের (যুদ্ধজয়ী প্রবীণ যোদ্ধা) সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলেও জানা গেছে। এদিকে, ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দু’ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই যোগ দেবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোভিন্দ। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ভারতের কোন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান অংশ নেননি। এটি এবারই প্রথমবারের মতো ঘটছে। ডিসেম্বরের ১৫ থেকে ১৭ তারিখের সময়সীমায় তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন বলে মোটামুটি চূড়ান্ত হয়েছে। ভারতের কোন রাষ্ট্রপতি শেষবার বাংলাদেশ সফর করেন আট বছরেরও বেশি সময় আগে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তখন প্রথম বিদেশ সফরে প্রণব মুখার্জী ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকায় আসেন। এর প্রায় ৯ বছর পর ভারতের কোন রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন ভুটানের সাবেক (চতুর্থ) রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিল বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। যুদ্ধের শেষভাগে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বয়সও ৫০ পূর্ণ করেছে। চলতি বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বরকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে মৈত্রী দিবস হিসেবে উদ্যাপনের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী অনেক দিন ধরেই চলছিল প্রস্তুতি। জানা যায়, আগামী ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারত বিশ্বের ১৮টি দেশে যৌথভাবে মৈত্রী দিবস উদ্যাপন করবে। জানা যায়, ৬ ডিসেম্বর ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারক বক্তৃতা’ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে। দিল্লীতে আইসিডব্লিউএ’র সাপ্রু হাউস মিলনায়তনে সেই বক্তৃতার সময় উপস্থিত থাকবেন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান তথা ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডুও। সূত্র জানায়, জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে দিল্লীতে এখন থেকে প্রতিবছর শেখ মুজিবুর রহমান স্মারক বক্তৃতা আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, দিল্লীর ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড এ্যাফেয়ার্স’ (আইসিডব্লিউএ) যারা পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে গবেষণা করে এবং দেশ-বিদেশের বহু অতিথিকে বক্তব্য জানাতে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানায় তারাই নিয়মিত বক্তৃতাটির আয়োজন করবে বলে জানা গেছে। এদিকে, এরই মধ্যে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২৬ নবেম্বর দিনাজপুরে উপ আঞ্চলিক মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচীর সূচনা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, ‘পথে পথে বিজয়’ শিরোনামে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত্রুমুক্ত হওয়ার দিনে আঞ্চলিক মহাসমাবেশ করা হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ২১টি মহাসমাবেশ আয়োজন করা হবে। পঞ্চগড়ে আঞ্চলিক মহাসমাবেশ হবে ২ ডিসেম্বর, যশোরে ৬ ডিসেম্বর, গোপালগঞ্জে ৭ ডিসেম্বর, কুমিল্লায় ৮ ডিসেম্বর, জামালপুরে ১১ ডিসেম্বর, কক্সবাজারে ১২ ডিসেম্বর এবং সিলেটে ১৫ ডিসেম্বর। ফরিদপুরে উপ-আঞ্চলিক মহাসমাবেশ হবে ১ ডিসেম্বর। মাদারীপুরে ৩ ডিসেম্বর, বাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ডিসেম্বর, ফেনীতে ৬ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহে ৬ ডিসেম্বর, শেরপুরে ৮ ডিসেম্বর, মিরসরাইয়ে ৯ ডিসেম্বর, পটিয়ায় ১১ ডিসেম্বর, মৌলভীবাজারে ১১ ডিসেম্বর এবং সুনামগঞ্জে ১৩ ডিসেম্বর উপ-আঞ্চলিক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। কর্মসূচী সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বছর ২০২১ সাল। সুবর্ণজয়ন্তীর বছরটিকে আমরা ইতিহাস চেতনা জাগ্রত করার কাজে লাগাতে চাইছি। উদ্যাপনের পাশপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করতে চাইছি। জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টিও বিশেষভাবে ভাবা হচ্ছে। ভেন্যুর এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন গ্যাসচালিত গাড়ি রাখা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, জাতীয় প্যারেড স্কয়ার, সংসদ ভবন, টুঙ্গিপাড়ায় এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন গ্যাস সিলিন্ডারের গাড়ি রাখা যাবে না। এক কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে সভাস্থলে আসতে হবে। জানা যায়, এই অনুষ্ঠান ঘিরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উপ-কমিটি এবং দেশী-বিদেশী অতিথিদের নিরাপত্তার জন্য আরেকটি উপ-কমিটি করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আগামী ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানস্থল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, এবারের বিজয়োৎসব উদ্যাপনে ৭টি উপ-কমিটি করা হয়েছে। এগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে বিজয় দিবস উদ্যাপন স্টিয়ারিং উপ-কমিটি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) নেতৃত্বে আমন্ত্রণ ও সংবর্ধনা উপ-কমিটি, ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে আহ্বায়ক করে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে আলোচনা ও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ-সংক্রান্ত উপ-কমিটি, সেনাবাহিনীর সাভারের ৯ পদাতিক ডিভিশন জিওসিকে (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) আহ্বায়ক করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে সশস্ত্র অভিবাদন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ উপ-কমিটি, যান্ত্রিক বহর প্রদর্শন সংক্রান্ত মূল্যায়ন ও স্থান নির্ধারণ সংক্রান্ত উপ-কমিটি এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে প্রধান করে নিরাপত্তা ট্রাফিক ও পুলিশের ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটি। তারও আগে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সংসদে সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা শেখ হাসিনার ১৪৭ বিধিতে উত্থাপিত প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। এর আগে প্রস্তাবটির ওপরে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারী, বিরোধী দল ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা দুদিনব্যাপী বিশেষ আলোচনায় অংশ নেন। এতে ৫৯ জন সংসদ সদস্য ১০ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে স্পীকার প্রস্তাবটি সংসদে ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
×