ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

প্রকাশিত: ২১:২৩, ২৯ নভেম্বর ২০২১

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার \ বিদেশী উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সব ধরনের সুযোগ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ সব নীতি সহায়তা দেয়ার জন্য প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে দুদিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন-২০২১’, এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ‘রেডিসন ব্ল’ হোটেলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের ১৫টি দেশের ২,৩৩২ জন নিবন্ধন করেছে জেনে আমি আনন্দিত হয়েছি। তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য আমরা সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করেছি। এ সব হচ্ছে, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র, এবং ব্ল-ইকোনমি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বেস করি, এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে এসব খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। বিশ্বে বাংলাদেশী পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিনদফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগ-নীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আসছে পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে। তাঁর সরকার ‘অর্থনৈতিক ক‚টনীতি’কে প্রাধান্য দিয়ে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা অর্থনৈতিক ক‚টনীতি প্রাধান্য দিচ্ছি। দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে কাজ করছি। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করেছি। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। ৩৬টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত-করারোপন পরিহার চুক্তি বলবত আছে। তাঁর সরকার বিভিন্ন বাণিজ্য জোটের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে অবকাঠামোসহ সকল নীতিগত সহায়তা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ বিশ্বে এখন উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ‘এসডিজি প্রোগ্রেস এ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। দেশে ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের ১২ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আহরণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের আইটি পণ্য রফতানির লক্ষ্য নিয়েছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতা শূন্য হাতেই ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে নেমেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। জাতির পিতা সকল কল-কারখানা জাতীয়করণ করে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করে বিনিয়োগ-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জাতির পিতা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ করে সার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কৃষক অল্প দামে সার পাবে, বেশি ফসল উৎপাদন করবে, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হবে, উদ্বৃত্ত খাদ্য ও সার বিদেশেও রফতানি করা যাবে। তাঁর উন্নয়ন দর্শনের মূলেই ছিল দেশীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং মানব সম্পদের উন্নয়ন। ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর এক জাতির পিতার এক ভাষণের উদ্বৃতি দেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির পিতা ভাষণে বলেন, ‘আপনাদের অনেক কষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশে সম্পদ আছে। সে সম্পদ ব্যবহার করা হয় নাই। ব্যবহার করতে সময় লাগবে। ইনশাল্লাহ, যদি বাংলাদেশের সম্পদ আমরা ব্যবহার করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ যে ‘সোনার বাংলাদেশ’ হবে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই।’ আওয়ামী লীগের ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের প্রসঙ্গ টেনে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারের ২০০০-০১ অর্থবছরে বর্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮১৬ মিলিয়ন ডলার। যেখানে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২৮৬ মিলিয়ন ডলার। আমরা ২০০০-০১ অর্থবছরে বিদ্যুত উৎপাদন ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করি, যেখানে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, আমরা যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করি। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ ও রফতানি উন্নয়নের লক্ষ্যে আইটি-ভিলেজ এবং হাইটেক-পার্ক গড়ার উদ্যোগ নিই। অথচ বিএনপি বিনামূল্যে ফাইবার অপটিক ক্যাবলে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর সরকারের সময় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন চিত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা জাতীয় শিল্পনীতিসহ খাতওয়ারি শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছি। প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। রফতানিমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য বন্ড ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশন করছি। আমরা ৩৯টি হাইটেক-পার্ক নির্মাণ করেছি। পর্যায়ক্রমে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ২৭.০৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি। মীরসরাই, সোনাগাজী ও সীতাকুন্ড উপজেলায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ গড়ে তুলছি। আড়াইহাজারে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। তিনি বলেন, অমরা ‘বাংলাদেশ সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব আইন, ২০১৫’ প্রণয়ন করেছি এবং সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে ৭৯টি পিপিপি প্রকল্পে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬’ প্রণয়ন করেছি এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১৯ সাল থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ৩৫টি সংস্থার ১৫৪টি বিনিয়োগ সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করেছি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, সৈয়দপুরে আঞ্চলিক বিমানবন্দর, কক্সবাজারে আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল এবং মাতারবাড়ি ও পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারীর প্রতিঘাত নিরসনে ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছি। ‘আমরা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতির আকার এখন ৪১১ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ ডলার। রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়ন করছি। তিনি মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে এই বিনিয়োগ সম্মেলনটি আয়োজন করায় সংশ্লিষ্ট সকলকে এবং অংশগ্রহণকারীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, সৌদি আরবের পরিবহন ও লজিস্টিক মন্ত্রী সালেহ নাসের এ আল-জাসের এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা পাঠান ভারতীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়াল, চীনের ভাইস মিনিস্টার ফর কমার্স রেন হংবিন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরেমি জার্গেন্স, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফানসো গার্সিয়া মোরা এবং প্রেসিডেন্ট কনজিউমার ডিউরেবলস অফ কোক হোল্ডিং এএস তুরস্ক। এছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি পাঠ করেন পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী হোন্ডা তারোর বার্তা। অনুষ্ঠানে ‘ডিসকভার লিমিটলেস’ শিরোনামের একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টারি প্রচার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ সম্মেলনের প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচনও করেন।
×