ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

২৭শ’ বছরের প্রাচীন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৮ নভেম্বর ২০২১

২৭শ’ বছরের প্রাচীন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় দুর্গম পাহাড়ে প্রায় ২৭শ’ বছর আগের প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশনের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে একটি আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র ‘নয়া দালান’। তারা বলছেন, প্রতœতত্ত্ব স্থানটি ঘিরে জাদুঘর ও পর্যটন কমপ্লেক্স গড়ে ওঠার সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। যার সঙ্গে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। তারা খনন ও গবেষণা প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মূলত প্রতœতাত্ত্বিক স্থানটির আবিষ্কারক গবেষক ওসমান গনি এনু। তার অনুসন্ধানটি বৃহৎ পরিসরে গবেষণার উদ্যোগ নেয় ‘নয়া দালান’। তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে মীরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নে পাহাড়ে ইন্দ্র রাজার বাড়ির বিভিন্ন নির্দশন পাওয়া যায়। শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নয়া দালানের প্রধান উপদেষ্টা ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এসব তথ্য জানান। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গবেষণা বিষয় প্রসার লাভ করেনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগসূত্রের কারণে গবেষণার প্রসার হয়নি বললেই চলে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই, আমাদের অতীত ইতিহাস জানতে হবে। এই অঞ্চলে আমাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি ছিল সভ্যতার নির্দশন। এসব উঠে আসা দরকার। মীরসরাই নতুন অবকাঠামো লাভ করতে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণ করবে; যা বাস্তবায়নের অংশ মীরসরাই ইকোনমিক জোন। এর সঙ্গে এই অঞ্চলের যে প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশনগুলো আমাদের গবেষকরা তুলে আনছে, এটা সত্যি গর্বের। এমন ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। এই অঞ্চলের সঙ্গে যে সভ্যতা, সংস্কৃতির যোগসূত্র বেশ আগে, তা বিশ^বাসী জানবে। নয়া দালানের প্রধান উপদেষ্টা এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জানান, মীরসরাইয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ‘নয়া দালান’-এর উদ্যোগে প্রতœতত্ত্ব স্থানটির ব্যাপক গবেষণা করা হয়। নয়া দালান স্থানীয় পরিবেশ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক, আইন ও বিচার নিয়ে গবেষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় গবেষক ওসমান গনির আবিষ্কৃত ইন্দ্র রাজার বাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রতœস্থানটি বাংলার ইতিহাসের পরিসীমাকে বৃদ্ধি করেছে। এই স্থাপনাটি আরও খনন করা হলে এবং বিস্তৃত গবেষণা হলে উঠে আসবে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাস। জানা যাবে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জীবনধারা। সংবাদ সম্মেলনে প্রতœতত্ত্ব স্থানটির আবিষ্কারক গবেষক ওসমান গনি এনু বলেন, হরিকেল রাজ্য থেকে চট্টগ্রামের সভ্যতা শুরু। ইন্দ্র রাজার বাড়ি ছিল ওয়াহেদপুরের এই পাহাড়ে। তিন দফা চেষ্টার পর আমি ইন্দ্র রাজার বাড়ির দেয়াল আবিষ্কার করি। স্থানীয় জনশ্রুতি ও প্রতœস্থলের পাশে মুরালি ছড়ায় প্রাপ্ত ইট, সুড়কির ওপর ভিত্তি করে ইন্দ্র পাহাড়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথমে খনন কাজ করি। পরে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ওয়াহেদপুর চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ইন্দ্র রাজার বাড়ি ও প্রতœতাত্ত্বিক বিস্ময় নামে একটি বইও লিখেছিলাম। তবে প্রাপ্ত দেয়ালের ইট, সুড়কি মহাস্থানগড় ও উয়ারী বটেশ^রের ইট, সুড়কির চেয়েও প্রাচীন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক ও নগরসভ্যতা বেশ পুরনো। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যকার সময়ে এসব নিদর্শনে প্রাপ্ত ইট, সুড়কি সম্প্রতি আমেরিকার কলোরাডো টেস্টের আরটেমিস টেস্টিং ল্যাবে তাপীয় আলোক-বিকিরণ পরীক্ষার সাহায্যে এই প্রতœস্থলের একটি নমুনা ইট পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় প্রতœস্থলটি ২৩০০ থেকে ২৭০০ বছরের প্রাচীন বলে প্রমাণিত। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় আমি পাহাড়ে প্রতœতত্ত্বের অনুসন্ধান করি। এটি এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। লিখিত বক্তব্যে নয়া দালানের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল ইসলাম জানান, মীরসরাইসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে এর আগে এত প্রাচীন কোন নিদর্শন আর পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে বোঝা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভ্যতা বেশ পুরনো। প্রতœস্থলটি স্বীকৃতি, স্থাপনার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বি¯ৃÍত পরিসরে খনন ও গবেষণার কাজ পরিচালনার জন্য আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। জেলা প্রশাসক ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মাধ্যমে খনন ও গবেষণা প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রতœস্থানটিকে ঘিরে জাদুঘর, বাওয়াছাড়া লেক ও পাহাড়। তাই এটি পরিপূর্ণ পর্যটন কমপ্লেক্স গড়ে ওঠার সম্ভবনা রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। প্রতœতাত্ত্বিক এই স্থাপনার গবেষণায় আরও যুক্ত হয় চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক সাদেকুজ্জামান তনু, একই বিভাগের প্রভাষক মুতাসিম বিল্লাহ। তারা বলছেন, যে নিদর্শন পাওয়া গেছেÑ তাতেই বোঝা যায় সে সময়ের নগরী ঘিরে গড়ে ওঠা সভ্যতা। এসব নিদর্শন খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যকার বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি আরও খনন করলে দেশের গৌরবজনক ইতিহাসের একটি অধ্যায় উন্মোচিত হবে। শুধু মীরসরাই নয়, এ অঞ্চলের ইতিহাসেও অজানা অধ্যায় সংযোজিত হবে।
×