ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের ছায়া

‘গরিবের আইনজীবী’ বাসেত মজুমদারের ইন্তেকাল

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৮ অক্টোবর ২০২১

‘গরিবের আইনজীবী’ বাসেত মজুমদারের ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গভীর শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য ‘গরিবের আইনজীবী’ খ্যাত এ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার। তিন দফা জানাজা শেষে কুমিল্লার লাকসামের (লালমাই) শানিচোঁ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। বুধবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্না লিল্লাহি... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুধবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ বন্ধ রাখা হয়। একই সঙ্গে ঢাকার নিম্ন আদালতের সব বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জানাজার আগে আব্দুল বাসেত মজুমদারের ছেলে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, বাবা ৫৪ বছর এ অঙ্গনে কাজ করেছেন। প্রতিদিন সকালে উঠে বলতেন, রাজা উঠো, তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। আর কোন দিন তিনি কোর্টে আসার কথা বলবেন না। প্রধান বিচারপতি বলেন, বাসেত মজুমদার ছিলেন গরিবের আইনজীবী। তার অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। জানাজায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপীল বিভাগের সব বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী শম রেজাউল করিম, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রীমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট মোঃ ফজলুর রহমান, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য আইনজীবী অংশ নেন। বনানী কেন্দ্রীয় মসজিদ, দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে ও কুমিল্লার শানিচোঁ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জাতীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে আব্দুল বাসেত মজুমদারের মরদেহে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর মরদেহ কুমিল্লার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮৩ বছর বয়সী বাসেত মজুমদার মেরুদ-ের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ফুসফুসের জটিলতা দেখা দিলে গত ২৩ অক্টোবর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাঈদ আহমেদ রাজা জানান, এর মধ্যে হার্ট এ্যাটাক হলে ২৪ অক্টোবর তার বাবাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। বুধবার সকালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লার লালমাই (সে সময় ছিল লাকসামের অধীনে) উপজেলার শানিচোঁ গ্রামে আব্দুল আজিজ মজুমদার ও জোলেখা বিবির সংসারে বাসেত মজুমদারের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রী নেয়ার পর তিনি আইন পেশায় যোগ দেন এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০১-০২ মেয়াদে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করার আগে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বাসেত মজুমদার। বাংলাদেশে আইনজীবীদের তদারককারী কর্তৃপক্ষ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানের পদেও তিনি দুই মেয়াদে ছিলেন। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আইনপেশায় নিয়োজিত বাসেত মজুমদার এক দিকে দুস্থ আইনজীবীদের জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ড করেছিলেন, অন্যদিকে বহু মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে আইনী সহায়তা দেয়ায় পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘গরিবের আইনজীবী’ হিসেবে। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার প্রার্থীদের আইনী সহায়তা প্রদানে আব্দুল বাসেত মজুমদারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, বাসেত মজুমদারের মৃত্যু দেশের আইন অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার মৃত্যুতে দেশ একজন দক্ষ আইনজীবীকে হারাল। রাষ্ট্রপ্রধান তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক, ও প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বুধবার এক শোক বার্তায় শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষকে আইনী সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি আইনজীবীদের পরম বন্ধুখ্যাত আব্দুল বাসেত মজুমদারের দেশের আইন অঙ্গনে অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আইনী বিষয়ে তিনি আদালতকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। দরিদ্র মানুষের আইনজীবী হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি জুনিয়র আইনজীবীদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। জাতি চিরকাল শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ রাখবে। পারিবারিক কবরস্থানে দাফন ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, হেলিকপ্টারে করে বাসেত মজুমদারের মরদেহ কুমিল্লার লালমাই উপজেলার হরিশ্চর হাইস্কুল মাঠে আনার পর তার মরদেহ নিজ বাড়ি শানিচোঁ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ মাগরিব শানিচোঁ প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তৃতীয় জানাজা হয়। এ জানাজায় হাজারো মানুষের ঢল নামে। এ সময় শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত জানাজায় কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন, কুমিল্লা আইনজীবী সমিতিসহ আইনজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ, বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ নানা শ্রেণী- পেশার নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্থমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম এমপি, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমাসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এমপি। এক শোক বার্তায় মন্ত্রী বলেন, মরহুম আব্দুল বাসেত মজুমদার ছিলেন একজন সৎ, নির্ভীক ও অভিজ্ঞ আইনজীবী। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবসময় সোচ্চার ছিলেন। আদালতে গরিব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ জন্য তিনি ‘গরিবের আইনজীবী’ নামেখ্যাত। আইনের শাসন ও মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ভুলবার নয়। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো। শোক বার্তায় আনিসুল হক মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের যুগ্মআহ্বায়ক ও বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এক শোক বিবৃতিতে তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুধবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ বন্ধ ছিল। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মোঃ আলী আকবর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে ঢাকার নিম্ন আদালতের সব বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, প্রয়াত আব্দুল বাসেত মজুমদারের কাছে আমি চিরঋণী। এই ঋণ কোন দিন শোধ করতে পারব না। বুধবার আব্দুল বাসেত মজুমদারের জানাজার আগে প্রধান বিচারপতি এ কথা করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আব্দুল বাসেত মজুমদার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাই তার সব সিভিল মামলা জুনিয়র হিসেবে হাইকোর্টে আমি লড়েছি। সুতরাং আব্দুল বাসেত মজুমদারের কাছে আমার যে ঋণ, সেই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না। আমি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই। উনার সব থেকে বড় পরিচয় ছিল উনি জুনিয়র আইনজীবীদের বন্ধু। জুনিয়ররা কত টাকা দিয়েছে, তা হিসেব না করে তিনি সব মামলা লড়েছেন। যখন যে আইনজীবী তাকে মামলা লড়তে বলেছেন, তিনি টাকার হিসেব না করে তা করে দিয়েছেন। অনেক গরিব মানুষের মামলা ফ্রিতে লড়েছেন তিনি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন সেই প্রার্থনা করি।
×