ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

জলোচ্ছ্বাস ঝুকিতে মানুষ

সবুজ দেয়াল বিলীনের শঙ্কা ॥ কুয়াকাটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল হচ্ছে বিরাণভূমি

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ২৬ অক্টোবর ২০২১

সবুজ দেয়াল বিলীনের শঙ্কা ॥ কুয়াকাটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল হচ্ছে বিরাণভূমি

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ সবুজের সমারোহে বিমোহিত সাগরপারের কুয়াকাটার উপকূল যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। ক্রমশ বিরানভূমি হয়ে যাচ্ছে। সতেজ সবুজ গাছগুলো এখন দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কালের মতো। এক যুগের ব্যবধানে এ সবুজ উপকূলের চিরচেনা সতেজ সবুজ দৃশ্যগুলো পরিণত হয়েছে অচেনা দৃশ্যের। মরাগাছগুলো যেন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে পরিবেশ প্রতিবেশের বিপর্যয়ের ভয়াবহ শঙ্কার। কুয়াকাটা সৈকতের পূর্বদিকে কুয়াকাটার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এমন মরে যাওয়া হাজারো ছইলা-কেওড়া গাছের সবুজ দেয়াল এখন ধুসর হয়ে বিলীনের শঙ্কায়। জাতীয় উদ্যান থেকে শুরু করে কুয়াকাটা ইকোপার্ক থেকে গঙ্গামতি লেকের পারে যেখানটায় দাঁড়িয়ে পর্যটকরা সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করেন সেখান পর্যন্ত মাইলের মাইলজুড়ে গাছের যেন মড়ক লেগেছে। উৎকন্ঠার একই দৃশ্য পশ্চিম দিকে খাজুরা পর্যন্ত। ২০০৭ সালের নবেম্বরে সুপার সাইক্লোন সিডরের ভয়াল তান্ডবের পর থেকে দীর্ঘ এ সবুজ দেয়ালে ধস শুরু হয়। সিডরে জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঝাপটায় হাজার হাজার গাছের শ^াসমূল চাপা পড়ে যায়। এরপর থেকে সাগরের ভাঙ্গন তীব্র হয়ে যায়। ফি বছর বর্ষাকালের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বালুর স্তর গিয়ে গাছের শ^াসমূল চাপা দেয়। এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। পরিবেশ কর্মীদের দাবি জলবায়ূর দ্রুত পরিবর্তনের কারণে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উপকূলজুড়ে। সবুজ দেয়ালখ্যাত এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিপন্নতা দেখে এ জনপদের মানুষের মধ্যে উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে বিরাজ করছে জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক। কুয়াকাটা সৈকতের দুইদিকে ধুলাসার, গঙ্গামতি, কাউয়ারচর এবং পশ্চিমদিকে খাজুরা ও লেম্বুরচর বনাঞ্চল রয়েছে। অন্তত ১০ হাজার একর জুড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল। এর মধ্যে ২০১০ সালের তথ্যানুসারে বনবিভাগ মহিপুর রেঞ্জের অধীন সংরক্ষিত কুয়াকাটা বিট, কুয়াকাটা ক্যাম্প, গঙ্গামতি, খাজুরা ও ধুলাস্বার ক্যাম্পের অধীনে বনভূমির পরিমান ছিল তিন হাজার ৯৭৮ দশমিক ৩৩ একর। এর মধ্যে কুয়াকাটা সৈকতের কুয়াকাটা বিটের ১৯৩ একর এবং কুয়াকাটা ক্যাম্পের অধীন বনভূমির পরিমান ছিল এক হাজার ৮১৮ দশমিক ৯৩ একর। সংরক্ষিত এ বনটি সিডরের পর থেকে বনদস্যু ছাড়াও বালুর নিচে শ্বাসমূল চাপা পড়ে মরতে থাকে হাজার হাজার গাছ। প্রাচীন এ গাছগুলো মরার পরে আবার এক শ্রেণির বনদস্যুরা গাছের গোড়ায় আগুন লাগিয়ে দেয়। নিশ্চিহ্ন করে দেয় আশপাশের বনাঞ্চল।অতি সম্প্রতি কুয়াকাটা সৈকতে পূর্বদিকে গঙ্গামতির লেকপাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, মরা, কাত হয়ে পড়ে থাকা কয়েকটি গাছে আগুন দেয়া হয়েছে। দিনের বেলা গাছগুলো জ¦লছে। নিভু নিভু আগুনে পুড়ছে। কৃষক ও জেলে দুটো পেশায় জড়িত আলম প্যাদা, গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। জানালেন, এ মানুষটি; এই গাছগুলো যেন কাটা না হয়। মরা গাছগুলো দাড়িয়ে থাকলেও লাভ। জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা ঠেকবে। পচে-গলে গেলেও নাকি বনের লাভ আছে। বালু-মাটির সঙ্গে পচা গাছ মিশে নতুন গাছ জন্মানোর কিংবা বেড়ে ওঠার উপযোগী হবে বেলাভূমির উপরিভাগ। লোকজজ্ঞান সমৃদ্ধ এ মানুষটি জানালেন, সিডরের পরেও বেড়িবাঁধ থেকে গভীর বনাঞ্চল ছিল। বনের মধ্যে চলাচলে ভয় লাগত। বন্যপশু বাস করত। এখন উজাড় হয়ে গেছে। এভাবে চললে পরের দশ বছরে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত বিলীনের শঙ্কা রয়েছে। আর বন থাকবেই না বলে শঙ্কা প্রকাশ করলেন আলম প্যাদা। মানুষের বাস উপযোগী জনপদ থাকবে না। কুয়াকাটা সৈকতের ওইদিকটায় মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু মরা গাছ পরে আছে। আবার সাগরের মধ্যে চরে মরা গাছের হাজারো গোড়া এখনও পড়ে আছে। একসময় সবুজ বাগান ছিল, অথচ; এখন সাগরের ঢেউ আছড়ে পরছে মরা গাছের নিচের অংশে। কুয়াকাটা সৈকতের পূর্বদিকে ইকোপার্কের দুই তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিলীন হয়ে গেছে সাগরে। বনাঞ্চলের মধ্যে নির্মাণ করা গোলঘরের খুটি দাড়িয়ে আছে বেলাভূমে। সড়কের কালভার্ট নেই। আর শত শত ঝাউ গাছ উপড়ে কাঁত হয়ে পড়ে আছে। ওই গাছগুলো এখনও উপকূল রক্ষার জন্য জোয়ারের ঝাপটাকে বাধাগ্রস্ত করছে। জাতীয় উদ্যানের গেটসহ দেয়াল পর্যন্ত সাগর গিলে খেয়েছে। একই দৃশ্য খাজুরা ও লেম্বুরচর বনাঞ্চলের। কাগজে-কলমে এ বনভূমির আয়তন ছিল ৩৪৬ দশমিক ৮৭ একর। এখন নেই বাস্তবে অর্ধেকটা। মাঝিবাড়ির জেলে আনোয়ার হোসেন জানান, আগে বনের মধ্যদিয়ে হেটে তারপর সাগরে যাওয়া লাগত। আর এখন ওই গাছ-জঙ্গল সব সাগরে ভেসে গেছে। বালুর নিচে চাপা পড়ে মরে গেছে অধিকাংশ গাছ। এখন জেয়ারারের সময় বেড়িবাঁধে আঘাত করে ঢেউ। দেখালেন এ মানুষটি, শত শত গাছ মরে দাড়িয়ে আছে। আগামি বছরে হয়তো এসব মরা গাছ উধাও হয়ে বিরানভূমি কিংবা সৈকতের বেলাভূমি হয়ে যাবে এসব এলাকা। আবার নতুন করে বাকি সতেজ-সবুজ গাছগুলো মরে যাবে। এভাবেই কুয়াকাটার উপকূলীয় এলাকার রক্ষাকবচ সবুজ দেয়ালখ্যাত সংরক্ষিত বনাঞ্চল একসময় সব উজাড় হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন মানুষ। কুয়াকাটার বহু মানুষের দাবি কয়েক লাখ গাছ মরে গেছে। বাকি গাছও থাকবে না। তাদের পরামর্শ ঢেউয়ের ঝাপটা বাধাগ্রস্ত করতে এখনই সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। রবিবার পরিবেশ বাদী সংগঠন বাপার মানববন্ধনেও বক্তারা এই সবুজ বনাঞ্চল রক্ষায় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
×