ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক পেজে প্রতারণায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১০ অক্টোবর ২০২১

ফেসবুক পেজে প্রতারণায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ প্রায় শতাধিক ফেসবুক পেজে ঋণ দেয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি প্রতারক চক্র। ডিজিটাল সুদের ব্যবসা চীন থেকে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এর সার্ভার রয়েছে চীনে। দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে অন্তত ৭ লাখ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রতারণার শিকার এসব মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চীনাদের হাতে চলে গেছে। এরকমই একটি প্রতারক চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, ইমানুয়েল এডওয়ার্ড গোমেজ, আরিফুজ্জামান, শাহিনূর আলম ওরফে রাজীব, শুভ গোমেজ ও মোঃ আকরাম। গত ৫ ও ৬ অক্টোবর রাজধানীর ধানমণ্ডি, বনানী ও মিরপুর এলাকা হতে তাদের গ্রেফতার করে গোয়েন্দাদের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এ ব্যাপারে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে অভিনব প্রতারণা থেমে নেই। একের পর এক প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে প্রতারক চক্র। এরা প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক পেজে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার কৌশল অবলম্বন করে। এরকমই শতাধিক ফেসবুক পেজে ঋণ দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব পেজ নজরদারি শুরু হয়েছে। এসব পেজের নিয়ন্ত্রণকারী দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি পুলিশকে জানান, তারা প্রথমে ফেসবুক পেজে ঋণ দেয়ার কথা বলে প্রচার শুরু করে। নিজেরা পেজের এ্যাডমিনে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা সেজে প্রশংসামূলক কমেন্ট করতে থাকে তাদের পোস্টগুলোতে। তারা এ্যাপসে লিংক দিতে থাকে। এতে অনেক সাধারণ মানুষ ঋণ নেয়ার আগ্রহ দেখান। ইন্সস্টল করেন এ্যাপসগুলোতে। এরপর তারা ঋণদাতা সেজে আগ্রহীদের কাছ থেকে এনআইডি ও কাগজপত্রসহ ব্যক্তিগত নানা তথ্য নেন। এ সময় তারা ঋণ দেয়ার কথা বলে আগ্রহীদের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেয়। আবার অনেকের কাছ থেকে দ্বিগুণ ও তিনগুণ সার্ভিস চার্জ নেয়া হয়। আর চার্জটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। চার্জের টাকা ফেরতযোগ্য নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয় আগ্রহীদের। এরকমই লাখ আগ্রহীর কাজ থেকে অফেরতযোগ্য চার্জের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ চড়া সুদে ঋণ পান। চড়া সুদ দিতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে অনেক মানুষ। অনেকে সুদের টাকা দেরি করলে তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া দিতো ডিজিট্যাল সুদ কারবারিরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, কিন্তু দেশে এ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্সের এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। তারপরও দেশে এরকম প্রায় শতাধিক পেজ ও এ্যাপস সচল আছে। যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও সার্ভার রয়েছে চীনে। গত ৫ ও ৬ অক্টোবর রাজধানীর ধানমণ্ডি, বনানী ও মিরপুর এলাকা হতে এই চক্রের ৫ জনকে করে গোয়েন্দাদের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, করোনাকালীন কর্মহীন মানুষদের বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের লোভ দেখিয়ে আসছে এ্যাপসভিত্তিক অবৈধ ঋণ প্রদানকারীরা। এ্যাপসের মাধ্যমে কৌশলে ঋণগ্রহীতাদের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। এসব ডকুমেন্টস দিয়ে পরে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। ঋণের বিপরীতে আদায় করা হয় মাত্রাতিরিক্ত টাকা। চক্রটি ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার প্রতারণা শুরু করে। দেশের কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে বলেও জানায়। তবে এ সবই তাদের প্রতারণার অংশ। দেশে এ ধরনের কোন ঋণ প্রকল্পের বৈধতা নেই। এছাড়া তারা যেসব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা এ্যাপসের মাধ্যমে চলে যাচ্ছিল চীনাদের হাতে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার জানান, অবৈধভাবে ডিজিট্যাল সুদ কারবারীরা গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করেছে। গ্রাহকরা এ্যাপসগুলো ইন্সটল করলেই সেগুলো মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি ও ভিডিও ধারণ, কনটাক্টস, লোকেশন, স্ট্যাটাস, মেসেজ সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে নিতো। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাদের সুদসংক্রান্ত এ্যাপসগুলোর মধ্যে রয়েছে, টাকাওয়ালা (পার্সোনাল লোনস অনলাইন), র‌্যাপিড ক্যাশ, আমার ক্যাশ, ক্যাশ ক্যাশ, স্বাধীনসহ আরও কিছু। এসব এ্যাপস ডাউনলোড হয়েছে ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত। এর মধ্যে র‌্যাপিড ক্যাশ ডাউনলোড হয়েছে অন্তত দশ লাখ বার। ঋণ নেয়ার জন্য যারা এগুলো ডাউনলোড করেছেন, তাদের সবার ব্যক্তিদের তথ্য চীনাদের হাতে ইতোমধ্যে চলে গেছে। তাদের অনেকের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নেয়া হলেও দেয়া হয়নি ঋণ। যাদের ঋণ দেয়া হয়নি। তাদের সার্ভিস চার্জের বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দেশী-বিদেশী চক্রটি। দেশে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন অন্তত সাত লাখ মানুষ। চড়া সুদ না দিলে হুমকি ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশীয় সুদকারবারি চক্রটি ইতোমধ্যে অনেককে ঋণ দিয়েছে। ঋণের চড়া সুদ না দিলে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিতো তারা। গ্রাহক তিন হাজার টাকার জন্য আবেদন করলে প্রসেসিং ফি বাবদ ৮১০ টাকা কেটে নেয়া হতো। এদে ২১৯০ টাকা দেয়া হতো। সাত দিন শেষেই গ্রাহককে পরিশোধ করতে হতো ৩০১৮ টাকা। মেয়াদ শেষে অনাদায়ে প্রতিদিন উচ্চহারে সুদও দিতে হতো। এছাড়াও এ্যাপ্লিকেশন ফি বাবদ ১২০ টাকা, ডাটা এ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা ও ভ্যাটের নামে ১৫ টাকা কেটে রাখত সুদকারবারি চক্রটি। ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার জানান, গ্রেফতারকৃতরা সরকারী অনুমোদন ছাড়া থান্ডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেড, নিউ ভিশন ফিনটেক লিমিটেড ও বেসিক ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। সক্রিয় ডিজিটাল সুদ কারবারীরা ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘স্বাধীন’ নামের একটি এ্যাপস ও পেজ থেকে ঋণ দেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নেয়া হতো। পেজটির এ্যাডমিন মোঃ বখতিয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি। পেজটিতে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেয়া হয়েছে। ঋণ নিতে চাইলে ওই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। বখতিয়ারের ওই নম্বরে ফোন দিলে তিনি নিজেই রিসিভ করেন। তারপর জানান, আমি আগে ঋণ দিতাম। এখন দেই না। এরপর তিনি কল কেটে দেন। এই ‘স্বাধীন’ নামে এ্যাপস ও পেসটি থেকে অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছে। স্বাধীন এ্যাপের বিরুদ্ধে অনেকে সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ করেছেন। ডিবির প্রধান হাফিজ আক্তার জানান, ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু করেছে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এমন আর অনেক পেজের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার কথা কড়া সুদ নিচ্ছে। অনেক ঋণ না দিয়ে তাদের সার্ভিস চার্জের মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরকম প্রায় শতাধিক এ্যাপ ও পেস সন্ধান পেয়েছে ডিবি পুলিশ। তারা নজরদারিতে রয়েছে। আমরা তদন্ত করে যাদের সম্পৃক্ততা পাব, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেবো বলে জানান তিনি।
×