ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সৌমিত্র শেখর

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রাম

শেখ হাসিনার মনে রাজনৈতিক জাগরণ একেবারে তাঁর শিশুকাল থেকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রবল স্রোত পাঁচ বছরের শিশু শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘‘পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’ ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।” এতেই বোঝা যায়, শেখ হাসিনার মধ্যে শৈশব থেকেই রাজনীতি বেশ আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই আন্দোলন তাঁর মনে দাগ কাটে। বলা চলে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিকজীবনের সূচনা এখান থেকেই। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে বিজয়ী হন এবং এরপরে তিনি হন মন্ত্রী। এ সময় ঢাকায় চলে আসেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার। গ্রামের বৃহৎ পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে শহরের খণ্ডিত আত্মীয়-পরিধি। বঙ্গবন্ধুও ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি আর মন্ত্রিত্ব নিয়ে। তখন সাত বছরের হাসিনাকে ছোটো দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালের তদারকিও করতে হয়েছে। ‘ম্যানেজমেন্ট’-এর শিক্ষাটি বোধ করি তাঁর এসময়ই হয়েছে। যখন তিনি স্কুলের ছাত্রী তখনই রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। নিজের কলেজের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে বিজয়ী হন শেখ হাসিনা। অন্য দুই প্রার্থীর ভোটের দ্বিগুণ ভোট পেয়ে তিনি প্রমাণ করেন জনপ্রিয়তায় তিনি শীর্ষে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিরাট মিছিলসহ শহিদ মিনারে তিনি যান শ্রদ্ধা জানাতে, সেখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়েন। এভাবেই স্কুল-কলেজের আন্দোলন-সংগ্রামে বক্তৃতা আর নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনেও সরাসরি শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি করেছেন তিনি। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মমতম হত্যাকাণ্ড। বেঁচে থাকেন দুটি মানবী : শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১- ছয় বছর তাঁদের নির্বাসনকাল। পিতার রক্ত আর আদর্শের উত্তরাধিকার বহন করে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফেরার। এই সিদ্ধান্তগ্রহণ খুব সহজ ছিল না। তিনি জানতেন না, দেশে ফেরার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হবে নাকি হত্যা করা হবে নাকি বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে। রীতিমতো শ^াপদসংকুল বাংলাদেশে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। দেশে এসে দেখেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন, ছাত্রনেতারা হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক, জনগণকে মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন করে বিভ্রান্ত করে রেখেছে সেনাশাসকেরা। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এক বছরও পার হয় না। একাধিক সামরিক ক্যু আর নির্বাচনের নামে প্রহসন চলে দেশে। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখর করে। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে খুবই সফলভাবে একক নেত্রী হিসেবে জাতির সামনে আবিভূত হন শেখ হাসিনা। কখনো নির্বাচন, কখনো আন্দোলন, কখনো ছোটো-বড়ো দলের সঙ্গে জোট, কখনো বৃহত্তম বাইশ দলের প্লাটফর্ম- রণনীতি ও রণকৌশলে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে বড়ো দক্ষতা, এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে সুসংবদ্ধ করা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দলটি যেখানে বড়ো বড়ো নেতার নেতৃত্বে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে দলকে ঐক্যবদ্ধ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। ১৯৯০-এ এরশাদের পতন নিশ্চিত হয় সত্য কিন্তু পরের বছর নির্বাচনে চক্রান্তের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রæয়ারি বিএনপি সরকার বিরোধী দলহীন নির্বাচন সম্পন্ন করে। এর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেন এবং ১৯৯৬ সালে ১২ই জুন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি-কে পরাস্ত করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তত্ত¡াবধায়ক সরকার-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই বিতর্কিত ও ঘৃণিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমান ও তাঁর সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেন না। গঠিত হয় বিএনপি, জামাত, ইসলামি ঐক্যজোট ও নাজিউরের জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে চারদলীয় জোট সরকার। কাগজে-কলমে চারদলীয় জোট হলেও এটা ছিল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির শক্ত প্লাটফর্ম। ফলে শেখ হাসিনাকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে অনেক বেশি অঙ্ক কষে এগোতে হয়। চারদলের অপশাসনের তাণ্ডবে দেশের মানুষ দিশেহারা, কর্মী-সমর্থকেরা ঘরছাড়া গয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকশক্তি বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। এরই মধ্যে তাঁকে হত্যাচেষ্টা চলে। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার জনসভায় শক্তিশালী বহু গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা হয়। সে দিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর কানের ক্ষতি হয় আর আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী আহত-নিহত হন। কিন্তু কোনো ভয়েই ভীত হন না শেখ হাসিনা। তিনি চারদলীয় জোট সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এরই মধ্যে এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং শেখ হাসিনাকে সংগ্রামের ধারা আবার পাল্টাতে হয়। যাঁর পিতা গণতন্ত্রের অগ্রদূত, সমতা-প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ, সেনাশাসনের সর্বসময় বিরোধিতাকারী, তিনিও যে সবসময় সেনাশাসনের বিরোধিতা করবেন, সেটাই সত্য। শেখ হাসিনা ফকরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য মাঠে নামেন। সেনা-সমর্থিত সরকার এটা বুঝতে পেরে গ্রেফতার করে শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের অনেক পরে বেগম খালেদা জিয়াকে আটক করে তারা। গ্রেফতার হলেও দমে যাননি শেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশ মতো সরকার-বিরোধী আন্দোলন চলে। কিন্তু কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আন্দোলনের তীব্রতা ও আন্তর্জাতিক মানবতাবাদীদের চাপে সরকার বাধ্য হয় শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে। চিকিৎসার জন্য তিনি ইংল্যান্ড যান। সেনা-সমর্থিত সরকার শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেবে না, দেশে ফিরলেই তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হবে- এমন আওয়াজ ওঠে। কিন্তু শেখ হাসিনা এবারও ভয় পান না। তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এর আগেও যেমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, এবারও চিকিৎসা নিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। তিনি ফিরে আসার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাতো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোটো-বড়ো সব শক্তি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসেন তিনি। নির্বাচন ঘোষিত হয়। সেনা-সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার অবশেষে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে ২৩০টি লাভ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার মতো ফল শেখ হাসিনার অকুতোভয় সংগ্রামী নেতৃত্বের কারণেই সেদিন হয়েছিল। এরপর তাঁর নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়। শেখ হাসিনা সরকার গঠনে বারবার দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে তিনি আওয়ামী লীগের সরকার নাম না দিয়ে নাম দেন ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি কিংবা আসম আবদুর রবকে মন্ত্রী করার ঔদার্য দেখান শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে গঠন করেন ‘মহাজোট সরকার’। এই সরকারে প্রায় লোকজনহীন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়াকে দেওয়া হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো একটি বড়ো মন্ত্রণালয়ের। জাতীয় পার্টির জিএম কাদের বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নানাভাবে সঙ্গে রেখে অংশ নেন এবং সরকার পরিচালনা করেন। জাসদ বা ওয়ার্কাস পার্টির নেতাদের তিনি মন্ত্রিত্ব দেন, লোক-সমর্থনহীন মোজাফফর ন্যাপকে দেন সংসদে নারী-সংরক্ষিত আসন, তরিকত ফেডারেশন বা বিকল্প ধারা দলকে নির্বাচনে ছেড়ে দেন কয়েকটি আসন। সংগ্রাম ও সমন্বয়ের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এখন বিশে^ একটি বিশিষ্ট নাম, যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আপসহীন।
×