ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে সরকারের নির্দেশনা

মৃত্যুঝুঁকি জেনেও মানুষ অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাস করছে

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ৩০ জুলাই ২০২১

মৃত্যুঝুঁকি জেনেও মানুষ অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাস করছে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে পাহাড়ধস ও ঢলের পানিতে প্রতিবছর অকাল মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাহাড়ধসে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা। গত দুদিনে পাহাড়ধস ও ঢলের পানিতে মারা গেছে ১৯ জন। দেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে কক্সবাজারেই পাহাড়ধসে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি কেন? এই প্রশ্ন সবার। সূত্রে জানা যায়, জেলা-উপজেলা প্রশাসন পাহাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করে যাচ্ছে। তবে অবৈধ দখলকারীরা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করেই চলেছে। তারা ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে বসবাস করছে। এ কারণে টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সরিয়ে উন্নতমানের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা ভাসানচরে স্থানান্তর করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিন বছর ধরে সরকারের এই মহতী উদ্যোগটি রোহিঙ্গারা উপেক্ষা করায় আশ্রয় ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছে পাঁচজন রোহিঙ্গা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একদিকে রোহিঙ্গারা উখিয়া টেকনাফ ছাড়াও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাহাড় দখল এবং পাহাড়ের অংশ বিশেষ ক্রয় করে বসতি স্থাপন করেছে। অন্যদিকে কতিপয় ভ‚মিদস্যু পাহাড় দখল করে প্লট আকারে বিক্রি করেছে রোহিঙ্গা ও বিভিন্ন এলাকার বহিরাগত ব্যক্তিদের। তারা পাহাড়ের গাছগাছালি কেটে সাবাড় করে বসতি স্থাপন করেছে চ‚ড়া ও পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়ের বৃক্ষরাজি এবং চ‚ড়া এবং মাঝখানে কেটে সমতল করার কারণে পাহাড়গুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতিবৃষ্টি শুরু হলে বা টানা ২-৩ দিনের বৃষ্টিতে পাহাড় ভেঙ্গে মাটি চাপা পড়ে বসতগৃহের ওপর। অনেক সময় ঘরসহ চ‚ড়া থেকে নিচে ধসে পড়ছে। এতে প্রাণহানি ঘটছে নারীপুরুষ, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের। তাদের ইন্ধন জুগিয়ে থাকে কতিপয় ধাঁন্ধাবাজ নেতা। কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থান তথা পাহাড়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করেছিল। এর প্রতিবাদে উচ্ছেদ হওয়া এবং পাহাড়সমূহে বসবাসকারী শত শত মহিলা কিশোরী এনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করিয়েছে এক শ্রেণীর জনপ্রতিনিধি। ওইসব জনপ্রতিনিধি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী নারী-পুরুষদের প্রশাসনের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মুখে এই সমাবেশ ও মানববন্ধন করার সুযোগ করে দিয়েছিল বলে জানা গেছে। কতিপয় নেতার উস্কানির কারণে বনবিভাগ, জেলা প্রশাসন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে বারবার পদক্ষেপ নিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারী কর্মকর্তাদের উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে শত শত মহিলার বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পর থেকে জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ অভিযান ভেস্তে যায়। দিব্যি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে হাজারো পরিবার। তারপরও সাগরে সতর্ক সঙ্কেত বা টানা বৃষ্টি-ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা দেখা দিলে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে সরে যাবার আহŸান জানানো হয়ে থাকে। জানা যায়, কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ হাজারের অধিক পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করে চলেছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার পাহাড় দখল করে বসতি গেড়ে দিব্যি বসবাস করেই চলেছে। উখিয়া টেকনাফের অর্ধ শতাধিক পাহাড় ও টিলা কেটে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার। এসব এলঅকার পাহাড়ের পাদদেশে, উপরে, খাদে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ৫০ হাজারের অধিক পরিবার। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধসে শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর অকাল মৃত্যু হয়েছে। ওইসব পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হলেও তারা কোনক্রমেই পাহাড় ছাড়তে রাজি নয়। তারপরও বর্ষা নামলে প্রশাসন ও বন বিভাগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনদের নিরাপদে সরে যাবার প্রচার চালিয়ে থাকে। টেকনাফ হোয়াইক্যং রেঞ্জের হোয়াইক্যং, শামলাপুর, শিলখালী, মনখালী, জাহাজ পুরা এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে স্থানীয় ও কিছু পুরাতন রোহিঙ্গা। দাপটে পাহাড়ে বসবাস করে পুরাতন রোহিঙ্গারা পাহাড়গুলো নিজের পৈতৃক সম্পত্তির মতো ভোগ দখল করছে। চকরিয়া, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় দখল করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি গেড়েছে স্থানীয় কিছুসংখ্যক প্রভাবশালীও। পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে বসবাসের সুযোগ পেয়ে অবৈধ বসতি পরিবারের বিস্তৃতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা মনে করছেন, বনকর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বন সম্পদ বেহাত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কোন প্রকার অবকাঠামো নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয় জানিয়ে সিডিএমপি ৭৫ শতাংশই বালু মিশ্রিত বলে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করেছে উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়গুলোকে। কতিপয় অসাধু বনকর্মীদের কারণে বিস্তৃর্ণ বনভ‚মি সরকারের হাতছাড়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। উখিয়া ও ইনানী বন রেঞ্জের মনখালী, ছেপটখালী, জুম্মাপাড়া, মোঃ শফির বিল, ইনানী জুমের ছড়া, সোনাইছড়ি, পাইন্যাশিয়া, তুতুরবিল, হরিণমারা, তেলখোলা, মোছার খোলা, হাতিরঘোনা, মধুরছড়া, মাছকারিয়া, দোছরী, থিমছড়ি, তুলাতলি, সোনারঘোনা, ডেইলপাড়া, ভালুকিয়া আমতলী, চিকনঝিরি পাগলির বিলসহ প্রায় শতাধিক পাহাড় দখল করে অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে হাজারো পরিবার। কক্সবাজার শহরের কলাতলী, দরিয়ানগর, ৫১ একর, পাহাড়তলী, লারপাড়া, ইসোলুঘোনা, বাঁচামিয়ারঘোনা, সাহিত্যিকাপল্লী, বড়ছরা, রাডার হাইজ এলাকা, টিএ্যান্ডটি পাহাড়, গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম, সরকারী কলেজের পেছনে, খুনিয়াপালং, চকরিয়ার ডুলাহাজরা, উখিয়া ও টেকনাফের শত শত পাহাড়ে জবর দখল, পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন, পাহাড়ের ওপর, পাহাড়ের ঢালু ও নিচে অসংখ্য বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
×