ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুকূপ ভূমধ্যসাগর

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২৯ জুলাই ২০২১

মৃত্যুকূপ ভূমধ্যসাগর

শংকর কুমার দে ॥ প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর মধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মানবপাচার। ভয়ঙ্কর রূপে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। অবৈধভাবে ইউরোপে মানবপাচারের মৃত্যুক‚প ভ‚মধ্যসাগর। নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে-এটা জেনেও ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রা করানো হচ্ছে অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশীদেরও। বেশি বেতনের আশায়, সুখী জীবনযাপনের প্রলোভনের টোপ ফেলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশীরা। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ছয় বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রায় ২১ লাখ মানুষ। এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় আটক হয়েছেন ৫৫ হাজার বাংলাদেশী। মানবপাচারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট এটি। ভূমধ্যসাগর দিয়েই ইউরোপে ঢুকতে হয়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশীরা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন তিউনিসিয়ার অধিবাসীরা। যেসব দেশের মানুষ ভ‚মধ্যসগার পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার মধ্যেও অন্যতম বাংলাদেশ। মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌযানডুবিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী কমপক্ষে ১৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে গত ২১ জুলাই তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, দেশটির কোস্টগার্ড সদস্যরা সাগর থেকে ৩৮০ জনের বেশি আরোহীকে উদ্ধার করেছে। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌযানডুবিতে কমপক্ষে ১৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপক‚লের জুয়ারা থেকে সিরিয়া, মিসর, সুদান, মালি ও বাংলাদেশের অভিবাসীদের নিয়ে রওনা দেয় নৌযানটি। রেড ক্রিসেন্ট জানায়, ১৭ বাংলাদেশী মারা গেছেন। ৩৮০ জনের বেশি অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা লিবিয়ার জুয়ারা থেকে ইউরোপের পথে রওনা দিয়েছিলেন। তবে মৃত ও উদ্ধার হওয়াদের নাম জানায়নি সংস্থাটি। বাংলাদেশীরা কিভাবে কার মাধ্যমে লিবিয়া গেছেন, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে মৃত্যুই বা কিভাবে হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে যাদের তাদের নামের তালিকা সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখবে অপরাধ তদন্ত বিভাগ। এর আগেও বাংলাদেশীরা লিবিয়া থেকে ইতালি বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সময়ে ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যু নয়তো দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হওয়ার পর নির্যাতিত মৃত্যুবরণের ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়ার উপক‚লে বেশ কয়েকটি নৌযানডুবির ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন অনেকে। এরপরও থেমে নেই এ পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা। সংস্থাটি জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশীরা। শুধু সমুদ্রপথ নয়, দুর্গম মরুপথ ও বনজঙ্গল পার হয়ে ইউরোপে যেতে গিয়ে অনেকে বন্দী হন, প্রাণও হারান। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত এক দশকে এক লাখেরও বেশি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন ইউরোপে। অবৈধভাবে প্রবেশ করা বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা বন্ধের হুমকিও দিয়েছে ইউরোপ। বাধ্য হয়ে প্রায় চার বছর আগে ইউরোপ থেকে অনিয়মিত বাংলাদেশীদের ফেরত আনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ফেরত আসা মানুষগুলোর জীবন যেন থমকে না যায়, সেজন্য দেশে ফেরত আসার পর তাদের পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগও নেয়া হয়। তারপরও ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালিতে মানবপাচার থামছেই না। অপরাধ তদন্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর মধ্যেই আবারও ভয়াবহভাবে শুরু হয়েছে মানবপাচার। ভয়ঙ্কর রূপে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান কিছুদিন বন্ধ থাকার পর মানবপাচারকারী চক্রের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার মধ্যেই মানবপাচারের বিপজ্জনক ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌযানডুবিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী কমপক্ষে ১৭ বাংলাদেশীর মৃত্যুর ঘটনার আগেও গত মাসে ভ‚মধ্যসাগর দিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপে পাচারকালে এক নৌকাডুবিতে ৩৩ বাংলাদেশী উদ্ধার ও ৫০ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। লিবিয়ার বন্দীশিবিরে মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার ২৪ যুবককে আটক রেখে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নির্যাতন করার অভিযোগের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত শুরু করছে। দালাল চক্রের মাধ্যমে বেশি বেতনের ভাল চাকরির প্রলোভন ও উন্নত জীবনের টোপ দিয়ে যুবক, নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মানবপাচারকারী চক্র। মানুষকে পাচারকালে সমুদ্রে নৌকাডুবিতে প্রাণ দিচ্ছেন, প্রতারিত হচ্ছেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য জিম্মি হয়ে নির্যাতিত হওয়াসহ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেও মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, এর আগে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকা সাগরে ডুবে যাওয়ায় এখনও ৫০জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছেন। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর সাগর থেকে যে ৩৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের পুলিশ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম এর কাছে খবর পেয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। পুলিশের কাছে আসা আইওএম-এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার সমন্বয়ক ফ্ল্যাভিও ডি গিয়াাকোমো এক টুইট বার্তায় প্রথম মানবপাচারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা লিবিয়ার জুয়ারা থেকে রওনা দিয়েছিল। টুইট বার্তায় দাবি করা হয়, তিউনিসিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ জেকরি জানিয়েছেন, সমুদ্রে তেলের খনিতে কর্মরত শ্রমিকরা একটি নৌকা ডুবে যেতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। এরপর সে এলাকায় তিউনিসিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী নৌবাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, তিউনিসিয়ার রেডক্রিসেন্টকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া খবরে বলা হয়েছে, লিবিয়া থেকে রওনা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় অন্তত ৫৭ অভিবাসনপ্রত্যাশী ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া উদ্ধার করা ৩৩ যাত্রীর মধ্যে সবাই বাংলাদেশী। ডুবে যাওয়া নৌকাটি ৯০ জনের মতো যাত্রী বহন করছিল। তিউনিসিয়ার বার্তা সংস্থা টিএপি জানিয়েছে, সোমবার তিউনিসিয়ার উপক‚লে আরেকটি নৌকা যখন ডুবে যাচ্ছিল, তখন নৌবাহিনী ১১৩ জনকে উদ্ধার করেছে। তারা সবাই বাংলাদেশ, মরক্কো এবং সাব-সাহারা আফ্রিকার অধিবাসী। অবৈধভাবে যারা ইউরোপে ঢুকতে চায়, তাদের জন্য সুবিধাজনক জায়গা হচ্ছে লিবিয়া। বাংলাদেশ থেকে অনেকে নানা উপায়ে লিবিয়ায় পৌঁছে। এরপর নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অনেকে ইতালি পৌঁছেছেন। পাশাপাশি সাগরে ডুবে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। ২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৪০ বাংলাদেশী। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বার বার। এরপরও থামছেই না ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার অবৈধ অনুপ্রবেশে মানবপাচার। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ঠেকাতে সাগরে নজরদারি বাড়ালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে সাগর পাড়ি দিচ্ছেন। আইওএম-এর হিসেবে ২০২১ সালের পাঁচ মাসে আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি এবং মাল্টা যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে ৫০০’র বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, লিবিয়ার বেনগাজিতে ২৬ বাংলাদেশীকে মুক্তিপণ আদায়ে জিম্মি করে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বছর না ঘুরতেই ফের সক্রিয় মানবপাচারকারী চক্র। এবার মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ২৪ যুবককে লিবিয়ায় বন্দীশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরালও হয়েছে ফেসবুকে। লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন পরিবারের সচ্ছলতার আশায় তবে মিলছে না নির্যাতন ছাড়া কিছুই। এই ঘটনায় জাহিদ নামে এক দালালকে আটক করেছে পুলিশ। আটক দালালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মাদারীপুরের এরশাদ এখন লিবিয়ায় জিম্মি অবস্থায় আটক আছেন। প্রায় ৬ মাস আগে বাবা-মার শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে অবৈধপথে ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে তাকে জিম্মি করে নির্যাতনের এক ভিডিও দেখিয়ে পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছে জিম্মিকারীরা। এরশাদ ছাড়াও সেখানে নির্যাতনের শিকার হিফজু, সগির, মাহমুদ, সানজিদসহ আরও ২৪ যুবক। গ্রামবাসীর অভিযোগ, একটি দালাল চক্র প্রতারণা করে যাচ্ছে সরল মানুষের সঙ্গে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে জাহিদ নামে একজনকে আটকও করেছে পুলিশ। গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ায় বেনগাজির মিজদাহ এলাকায় মানবপাচারকারীর গুলিতে যে ৩৬ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয় তার মধ্যে মাদারীপুরেরই ১২ জন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে মানবপাচারের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় এখন শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে মানবপাচার দমন করলেও, মানবপাচারের হোতাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পরও কোন অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। দালাল চক্র অবৈধ পথে ইউরোপে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে তরুণদের মোহে ফেলে বিদেশে ‘রিসিভ ঘর’-এ আটকে মুক্তিপণ আদায় করছে। এতে তাজা প্রাণ ঝরে যায় এবং পরিবার ভিটেবাড়ি হারিয়ে পথে বসে। জীবনের গল্প বদলে ফেলার আশায় অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশের দিকে পা বাড়াচ্ছেন। কেউ দেশের বাইরে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে টের পাচ্ছেন যে প্রতারিত হয়েছেন। ভাল চাকরি ও উন্নত জীবনের টোপ দিয়ে মানবপাচারকারীরা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের যৌনশোষণমূলক কাজে জড়াতেও বাধ্য করা হচ্ছে। অনেককে আটকে রেখে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। বিদেশ থেকে জীবন নিয়ে কোনমতে ফিরে আসা মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এই বিভীষিকার চিত্র। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোভিড মহামারীর সঙ্কটের ভেতর মানবপাচারের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। গত বছর সুদূর লিবিয়ার মরুভূমিতে পাচারকারীর হাতে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশী ৩৬ বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ঘটনায় সরকারের প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা একযোগে তৎপর হয়। র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডির হাতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইউরোপে পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের সংবাদ জনমনে কিছুটা আস্থা আনে। বেশি বেতনের ভাল চাকরি, উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে একটুখানি স্বপ্ন আর সুখ সমৃদ্ধির আশায় স্বপ্নচারী মানুষেরা বেশির ভাগই পড়েন মানবপাচারকারীর খপ্পরে। জমি, বসতভিটা বিক্রি করে শেষ সম্বলটুকু তাদের হাতে তুলে দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন নয়তো প্রতারিত হন। অনেক সময় অনেক কষ্টে বিদেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেও কাজ আর মেলে না। পালিয়ে, অনাহারে কাটাতে হয় জীবন। তারা না পারেন দেশে ফিরতে, না পারেন বিদেশের মাটিতে টিকতে। এটা আমাদের ত্রæটিপূর্ণ অভিবাসন ব্যবস্থার এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এটা বন্ধে কখনও সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি। লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় এসব মধ্যবিত্ত যুবকদের লিবিয়া বা ভূমধ্যসাগর তীরের আশপাশের দেশে নিয়ে, সেখানে তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে বড় মাপের মুক্তিপণ আদায় করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পাচার চক্র। কিন্তু কেন প্রতিবার এদের ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি অথবা পাচারকারীদের হাতে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলেই কেবল টনক নড়ে! ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৯৭০ ॥ এদিকে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির এক খবরে বলা হয়েছে, লিবীয় উপক‚লে সর্বশেষ ৫৭ অভিবাসীর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে চলতি বছর ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইউরোপের কোন দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৯৭০ জনে দাঁড়াল। মঙ্গলবার জাতিসংঘ একথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইওএম) জানায়, কমপক্ষে ৫৭ অভিবাসী লিবিয়া উপক‚লে তাদের নৌকা ডুবে যাওয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমধ্যসাগর সি ক্রসিং রুট পাড়ি দিয়ে ইউরোপে চলে যাওয়ার সময় ঘটা এটি হচ্ছে সর্বশেষ মর্মান্তিক ঘটনা। আইওএম জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেছে, নিখোঁজদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ নারী ও দুই শিশু রয়েছে। রবিবার রাজধানী ত্রিপোলির প্রায় ১২০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত লিবিয়ার খোমস বন্দর থেকে নৌযানটি ছেড়ে যায়। পরে সমস্যা দেখা দেয় এবং পানি ঢুকে পড়ায় তা ডুবে যায়। আইওএম মুখপাত্র পল ডিলন বলেন, ‘স্থানীয় জেলে ও লিবীয় কোস্টগার্ড পানি থেকে ১৮ জনকে উদ্ধার করেছে।’ ‘প্রাণে বেঁচে যাওয়া এসব ব্যক্তি আমাদের স্টাফকে বলেছে, এ নৌকাডুবির ঘটনায় কমপক্ষে ৫৭ জন নিখোঁজ রয়েছে।’ ‘লিবিয়ায় থাকা আমাদের স্টাফরা প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জরুরী চিকিৎসাসেবা, খাদ্য, পানি ও সান্ত¡না দেয়।’ তারা সকলে নাইজিরিয়া, ঘানা ও গাম্বিয়ার নাগরিক।’ ২০২১ সালের এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর রুটে এ নিয়ে প্রায় ৯৭০ পুরুষ, নারী ও শিশু প্রাণ হারাল।
×