স্টাফ রিপোর্টার ॥ যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ত্যাগের মহিমায় বুধবার সারাদেশে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা উদ্যাপিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবারও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিন্ন এক আমেজে মসজিদে মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে করোনা থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করা হয়। এ ছাড়া মুসল্লিরা দেশ, জাতি ও মুসলিম জাহানের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করেন। তবে এবারের ঈদে তেমন উৎসবের আমেজ ছিল না।
ঈদগাহে ব্যাপক জনসমাগম করে ঈদের নামাজ না পড়তে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবারও মসজিদেই জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। তবে কেউ কেউ মসজিদে না গিয়ে নিজ নিজ ঘরে ঈদের নামাজ আদায় করেন। আগের মতো নামাজের পর কেউ কারো সঙ্গে কোলাকুলি করেননি। তবে পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। ঈদের নামাজ আদায় শেষে মহান আল্লাহর সন্তষ্টির উদ্দেশে পশু কোরবানি করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কোরবানির মাংস দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করেন তারা।
প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদ-উল-আজহা পালিত হয়। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর বিগত ৩ ঈদের মতো এবারও জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের পরিবর্তে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদে সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত হয় ঈদের প্রথম জামাত। প্রথম জামাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মোঃ মিজানুর রহমান। মুকাব্বির ছিলেন বায়তুল মোকাররমের মুয়াজ্জিন মোঃ আতাউর রহমান। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মুসল্লিরা স্বস্তিতে ঈদের নামাজ শেষে পশু কোরবানি করেন।
করোনা ভীতিকে উপেক্ষা করেই বিপুল সংখ্যক মানুষ এবারও রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ-উল-আজহা উদ্যাপন করেছেন। আবার অনেকেই শহর ছেড়ে যাননি। করোনার কারণে ঘরবন্দী হয়েই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তারা। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অবস্থান করা প্রিয়জনদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
মহান আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় পুত্র ইসমাইল (আ)কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ) মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা, অবিচল আনুগত্য ও আকুণ্ঠ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সারাবিশ্বের মুসলমানরা প্রতিবছর ঈদ-উল-আজহার নামাজের পর আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় পশু কোরবানি করেন।
প্রতিবারের মতো এবারও মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীসহ বিশ্বের সব মুসলমানদের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, এ বছর এমন একটা সময় ঈদ-উল-আজহা উদ্যাপিত হয়েছে যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসের সংক্রমণে চরমভাবে বিপর্যস্ত। করোনার কারণে দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তিনি বলেন, কোরবানি আমাদের মাঝে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা সঞ্চারিত করে, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার মনোভাব ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, হযরত ইব্রাহীম (আ) মহান আল্লাহর উদ্দেশে প্রিয়বস্তুকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আসুন কোরবানির ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করি। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ঈদ-উল-আজহার নামাজ আদায়ের বিষয়ে এবারও বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই বিধিনিষেধ মেনেই মুসল্লিরা মসজিদে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। বিধিনিষেধের মধ্যে ছিল- মসজিদে ঈদের নামাজ আয়োজনের ক্ষেত্রে কার্পেট বিছানো যাবে না। নামাজের পূর্বে পুরো মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মুসল্লিদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে মসজিদ আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদের ওজুর স্থানে সাবান, পানি ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান ও পানি রাখতে হবে। ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। ঈদের নামাজ আদায়ের সময় কাতারে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই অনুসরণ করে দাঁড়াতে হবে এবং এক কাতার অন্তর অন্তর কাতার করতে হবে। শিশু, বয়োবৃদ্ধ, ও অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়। এসব বিধিনিষেধগুলো সব মসজিদেই পালন করা হয়। তবে কোন কোন মসজিদে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হয়নি বলে জানা যায়।
ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে এবার ২০ থেকে ২২ জুলাই এ ৩ দিন ছিল সরকারী ছুটি। যদিও সরকারী চাকরিজীবীরা এ ৩ দিনের সঙ্গে শুক্র ও শনিবার মিলিয়ে ৫ দিন ছুটি পেয়েছে। ঈদ উপলক্ষে এবারও বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ দেশের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বসহকারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে দেশের সব সরকারী হাসপাতাল, কারাগার, সরকারী শিশু সদন, বৃদ্ধ নিবাস ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
চট্টগ্রাম ॥ চট্টগ্রাম অফিস জানায়, গত বুধবার চট্টগ্রামে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-আজহা পালিত হয়েছে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে খোলা মাঠ বা ময়দানের পরিবর্তে বড় থেকে ছোট সব ধরনের মসজিদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপরে স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় কোরবানির পশু জবাই করা হয়।
এদিকে, কোরবানির বর্জ্য অপসারণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ব্যাপকভাবে দায়িত্বশীল ছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পশুর বর্জ্য অপসারণে সিটি মেয়র রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ৪১ ওয়ার্ড কাউন্সিলর সমন্বয়ে চার জোনে বিভক্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি অতি দ্রুততার সঙ্গে তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চসিকের সাড়ে চার হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ করা হয়। এছাড়া ৩শ’ যানবাহন ছিল এ ব্যবস্থাপনায়। এছাড়া স্ট্যান্ডবাই রাখা হয় আরও আড়াই শ’ যানবাহন। মেয়রের পক্ষে প্যানেল মেয়র ও ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডের বার বার নির্বাচিত কমিশনার মোঃ গিয়াস উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, কোরবানির দিন বিকেল থেকে বর্জ্য অপসারণ কাজ শুরু হয়। এরপর শুক্রবার পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখা হয়। কেননা, দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো চট্টগ্রামেও টানা তিনদিন কোরবানির পশু জবাই করা হয়। এদিকে, চসিকের আয়োজনে জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদের প্রধান জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সকাল ৭ ও ৮টায় দুদফায় জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া চসিকের লালদীঘি জামে মসজিদ, সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় জামে মসজিদ, হযরত চশমা মসজিদ ঈদগা, চকবাজার চসিক জামে মসজিদ, চসিক মা আয়েশা সিদ্দিকা জামে মসজিদসহ প্রায় সকল মসজিদে ঈদ জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৭টার পর থেকে পশু কোরবানি শুরু হয়। পশু জবাইয়ের জন্য চসিক নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ৩০৪টি স্থান নির্ধারণ করলেও এর চেয়ে বেশি স্থানে পশু কোরবানি দেয়া হয়।
এবারের কোরবানিদাতাদের চসিক প্রদত্ত নির্দেশনা অনেকাংশে মানতে দেখা গেছে। এছাড়া ঈদের নামাজ আদায়ের সময় পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিও লক্ষণীয়। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে জামায়াত শেষে চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী কোলাকুলি বা হাত মেলানো থেকে বিরত ছিলেন মুসল্লিরা।