ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইন্ধন থাকতে পারে শফিকুলের

কদমতলীর তিন খুনের দায় স্বীকার করলেন বড় মেয়ে মুন

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২৫ জুন ২০২১

কদমতলীর তিন খুনের দায় স্বীকার করলেন বড় মেয়ে মুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরান ঢাকার কদমতলীতে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের ছোট মেয়ে খুনের ঘটনার দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে ওই দম্পতির বড় মেয়ে গ্রেফতারকৃত মেহজাবিন ইসলাম মুন। বৃহস্পতিবার চার দিনের রিমান্ড শেষে মুনকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) জাকির হোসাইন। মুন স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা তারা জবানবন্দী রেকর্ড করেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২০ জুন মুনের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ২১ জুন তার স্বামী শফিকুল ইসলামের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা ২৬ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি দেশে আসতেন। মাসুদ রানা তার মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুনকে শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে দেন। এরপর থেকে মেহজাবিন সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য তার মা মৌসুমি ইসলামকে বিভিন্নভাবে চাপ দিতেন। সম্পত্তি লিখে না দেয়ায় মেহজাবিন ও তার স্বামী শফিকুল ছয় মাস আগে থেকে মাসুদ রানা, তার স্ত্রী মৌসুমি এবং মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মাসুদ রানা তিন মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে আসেন। মেহজাবিন ও তার স্বামী শফিকুল গত ১৮ জুন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মাসুদ রানার বাসায় আসে। রাত ৯টা থেকে বিভিন্ন সময়ে চা-কফি ও পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মাসুদ রানা, মৌসুমি ইসলাম এবং মোহিনীকে তা খাওয়ানো হয়। এতে সবাই অচেতন হলে আসামিরা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে একে একে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ ঘটনায় মাসুদ রানার বড়ভাই সাখাওয়াত হোসেন মেহজাবিন ও শফিকুলকে আসামি করে কদমতলী থানায় মামলা দায়ের করেন। এদিকে মামলার অপর আসামি শফিকুল ইসলামকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মেহজাবিন ইসলাম মুন আদালতে এই হত্যাকাণ্ডে দায় স্বীকার করেছে। হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেও নেপথ্যে থাকতে পারে তার স্বামী শফিকুল ইসলামের পরোক্ষ ভূমিকা। বৃহস্পতিবার রিমান্ডের তৃতীয় দিনে শফিকুল ঘটনার সময় অসুস্থ থাকার কথা বললেও তার পরকীয়া এবং শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তির ওপর নজরের বিষয়টিও তদন্ত করছে। এ কারণেই তাকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে নিহতের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মেহজাবিন একা তিনজনকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছেন। তারা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। তারা মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মেহজাবিনের স্বামী শফিকুল ইসলাম এবং তার ঘনিষ্ঠ আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। এ ঘটনার নেপথ্যে পরকীয়ার ও বিশাল সম্পত্তি দখলের চেষ্টায় তারা জড়িত থাকতে পারে। কারণ মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা দীর্ঘ ২৬ বছর প্রবাসে ছিলেন। পুরান ঢাকায় তার বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। ওই সম্পত্তি দখল করতে শফিকুল এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভূমিকা রাখতে পারে। মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন বলেন, শুনেছি আদালতে মুন হত্যার দায় স্বীকার করেছে। তবে অর্থ ও সম্পত্তির জন্য এ হত্যাকাণ্ডে মেহজাবিনের নেপথ্যে তার স্বামী শফিকুলের ইন্ধন থাকতে পারে। পাঁচ বছর আগে পারিবারিকভাবে শফিকুল-মেহজাবিনের বিয়ে হয়। এর কিছুদিন পরই পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ তৈরি হয়। বিয়ের পর মেহজাবিনের ছোট বোন জান্নাতুলের ওপর নজর পড়ে শফিকুলের। এক পর্যায়ে মেহজাবিন ও তার মা মৌসুমি শফিকুলের এ বিষয়টি জানতে পারেন। মৌসুমি জামাতা শফিকুলকে নিয়ন্ত্রণের অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে শফিকুলের বিরুদ্ধে মামলাও করেন মৌসুমি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শফিকুলও শাশুড়ি মৌসুমির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন। শফিকুলের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে মৌসুমি অসহায় হয়ে পড়েন। আরেক স্বজন বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে মৌসুমি তার ছোট মেয়ে জান্নাতুলকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। শফিকুল এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে সে মেহজাবিনের সঙ্গেও নানাভাবে অশান্তি সৃষ্টি করে। শফিকুল পাঁচ মাস পর জান্নাতুলকে জামিনে কারাগার থেকে বের করে এনে আবার তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখে। মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন আরও বলেন, শফিকুল এই পরিবারের অনেক ক্ষতি করেছে। সে একবার আমার বোনকে (মৌসুমি) হত্যার উদ্দেশে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। চিকিৎসা করতেও বাধা দেয়। দরজা-জানালা বন্ধ করে আমার বোন ও ভাগ্নিকে প্রায়ই মারধর করত বলেও আমরা জেনেছি। প্রতিবাদ করায় আমাকেও হুমকি দিত শফিকুল। ইয়াসমিনের অভিযোগ, সংসারের অভিভাবক বিদেশে থাকার সুযোগ নিয়ে শফিকুল পুরো পরিবারটিকে জিম্মি করে ফেলেছিল। মেহজাবিন হত্যাকাণ্ডের দোষ একা নিতে চাইলেও আমরা মনে করি শফিকুল পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। তিনি জানান, শফিকুল এলাকার মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য। মৌসুমিকে অনেকটা জিম্মি করে মেহজাবিনকে বিয়ে করেছিল সে। স্বজনরা জানান, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমিন নামের এক ব্যক্তিকে হত্যাকাণ্ডের মামলায় গ্রেফতার হয় শফিকুল। ছয় মাস কারাগারে আটক থেকে পরে জামিন পান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত শনিবার সকালে কদমতলীর মুরাদপুর রজ্জব আলী সরদার রোডের পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয়তলা থেকে মাসুদ রানা (৫০), তার স্ত্রী মৌসুমি ইসলাম (৪০) ও মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর (২০) হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অচেতন অবস্থায় মেহজাবিনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও মেয়ে চার বছরের শিশু তৃপ্তিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় মেহজাবিন ও তার স্বামী শফিকুলের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) জাকির হোসেন বলেন, ৩ খুনের ঘটনায় নিহত মাসুদ রানার বড়ভাই সাখাওয়াত হোসেন মামলা দায়ের করেছেন। সেই মামলায় শফিকুলকে ১ নম্বর আসামি ও মুনকে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে শফিকুলকে তিন দিনের রিমান্ড নেয়া হয়েছে। আর মুনকে চার দিনের রিমান্ড নেয়া হয়েছে।
×