ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহ্য মেনে ওয়ানগালা উৎসব, চর্চা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৪ জুন ২০২১

ঐতিহ্য মেনে ওয়ানগালা উৎসব, চর্চা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ কত রকমের উৎসব যে হয় বাংলাদেশে! একেক উৎসবের একেক চরিত্র। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও স্বতন্ত্র আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এসব উৎসব উদ্যাপিত হয়। দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে উৎসবগুলোর জুড়ি নেই। বাঙালী তো বটেই, অন্য নৃ-গোষ্ঠীও তাদের কৃষ্টি-কালচার বহু বহু কাল ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। তো, এসব উৎসব অনুষ্ঠানেরই একটি ওয়ানগালা। গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বুধবার নেত্রকোনায় শুরু হয়েছে। দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরিতে অবস্থিত উৎসবের আয়োজন করেছে ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতি বছরই বিপুল আয়োজনে উৎসব আয়োজন করা হয়। এবার করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে কিছুটা সীমিত পরিসরে উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। দুই দিনব্যাপী আয়োজন ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে আগ্রহের কমতি নেই। অবশ্য জাতীয় পর্যায়ে এ উৎসব অতটা পরিচিত নয়। স্থানীয়রা একে প্রধানতম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। গারোদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এ উৎসব চমৎকার ধারণা দেয়। ওয়ানগালা গারো সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একে কৃষিভিত্তিক সামাজিক উৎসব বলা যায়। গারো বা মান্দি ভাষায় ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ ‘নৈবেদ্য’ বা ‘দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সামগ্রী।’ আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ ‘কোন কিছু উৎসর্গ করা’। আগেকার সাংসারেক ধর্মাবলম্বী গারো তাদের নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় কিছু পরিমাণ সূর্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ বা ‘সালজং মিদ্দিকে’ উৎসর্গ করতেন। শস্য উৎসর্গ করার এ উৎসবটির নামই ‘ওয়ানগালা’। আরও সহজ করে বললে, গারোদের নবান্ন উৎসব। তবে সাংসারেক ধর্মচর্চা এখন প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমানে গারোদের বড় অংশটি খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এরপরও তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী আদি উৎসবের প্রথাটি ধরে রেখেছেন। অর্থাৎ খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী গারোরাও প্রতিবছর সাড়ম্বরে ওয়ানগালা উৎসব উদ্যাপন করে থাকেন। এ উৎসবের আগে তারা কেউই নতুন উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না। আগেকার ওয়ানগালার সঙ্গে এখনকার ওয়ানগালার মৌলিক পার্থক্যটি হচ্ছে- এক সময় তারা সূর্য দেবতা মিসি সালজং বা সালজং মিদ্দিকে উৎসর্গ করতেন। আর এখন তারা উৎসর্গ করেন যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। নিজস্ব সংবাদদাতা নেত্রকোনা থেকে জানান, এবার কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। বরাবর ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ লোক সমাগম হয়Ñ এবার তা হয়নি। অনেকটাই ভার্চুয়ালি উদ্যাপন করা হচ্ছে। প্রথম দিন একাডেমির সাংস্কৃতিক দলের শিল্পীরা গারোর ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কাজী মোঃ আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মানু মজুমদার, জুয়েল আরেং, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ বদরুল আরেফীন প্রমুখ। উৎসব বিষয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি মিঠুন রাকসাম। আলোচনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক গীতিকার সুজন হাজং। শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন দুর্গাপুর উপজেলার ইউএনও মোহাম্মদ রাজীব উল আহসান। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সংস্কৃতি ধারণ, লালন ও চর্চার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহমান থাকে। এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখেই বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকার জাতীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পরিচর্যা, বিকাশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বর্তমানে সাতটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, গারোদের অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যগুলোকে আমরা সংরক্ষণ এবং চর্চার মধ্যে রাখতে চাই। এ সময় গারো ছাড়াও হাজংসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো নিয়ে বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা তৈরির জন্য একাডেমি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি। একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং জানান, আজ বৃহস্পতিবারও থাকবে বর্ণাঢ্য আয়োজন। সকালে গারোদের গান, নৃত্য ও আলোচনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। করোনাকালেও নৃত্য ও সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে মূলত ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
×