ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনলাইনে আমের হাট জমজমাট কেনাবেচা

প্রকাশিত: ২১:২২, ১১ জুন ২০২১

অনলাইনে আমের হাট জমজমাট কেনাবেচা

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে রাজশাহীতে জারি করা হয়েছে বাড়তি বিধিনিষেধ। বিকেল ৫টা বাজতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব দোকানপাট ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এতে আমের বাজারে মানুষ কমছে। তবে অনলাইনে আমের বেচাকেনা জমে উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অবসর সময়ে অনলাইনে আমের ব্যবসায় ঝুঁকেছেন শিক্ষার্থীরা। রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে গ্রুপ, পেজ ও ওয়েবসাইট খুলে সমানতালে আমের প্রচার- চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সুবাদে লাইভ করে বাগানের আম দেখানো, আম নামানো এবং প্যাকেটিং কার্যক্রম দেখিয়ে নানাভাবে সব ধরনের ক্রেতাদের নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন। এই ফেসবুকের মাধ্যমেই ঢাকাসহ দেশের জেলার গ্রাহকরা পছন্দ অনুসারে আম কিনতে পারছেন। কেনার পর তারা প্রাপ্ত আম নিয়ে অনলাইনে মন্তব্যও করছেন। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, এবার রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ১৯ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। স্থানীয় আম ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত সময়ে অনলাইনে আমের বেচাকেনা ছিল না। এবার তরুণ শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ ও ওয়েবসাইটসহ নানা মাধ্যমে আম বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্ডার নিচ্ছেন। ফলে ভিড় বাড়ছে রাজশাহীর বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস ও রেল স্টেশনসহ ঢাকাগামী বাস টার্মিনালে। আর অর্ডার নেয়া আম কার্টনে প্যাকিং করে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। অনলাইনে ব্যবসার ফলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে চাষীরা পাচ্ছেন আমের ন্যায্যমূল্য। আর ভোক্তারা অল্প সময়ের মধ্যে পাচ্ছেন চাহিদা অনুযায়ী ফরমালিনমুক্ত সুস্বাদু ও পরিচ্ছন্ন আম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র মনু মোহন বাপ্পা। লকডাউনের ছুটিতে চলে গেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের বসনইল গ্রামে। গ্রামে থেকে আমের ব্যবসা করছেন। অনলাইনেই বিক্রি করছেন বেশিরভাগ আম। ‘রেইনবো ম্যাঙ্গো স্টেশন’ নামে তার একটি ফেসবুক পেজ আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত তিনি অনলাইনে ৭০ মণ গোপালভোগ ও খিরসাপাত আম বিক্রি করেছেন। বাপ্পা বলেন, আমাদের নিজস্ব ১০০ বিঘা আমের বাগান আছে। তারপরও খিরসাপাত আর ল্যাংড়ার ৬০০টির মতো গাছের শুধু আম কিনে নিয়েছি। এছাড়া ফজলি, আম্রপালি, বারি-৪ আর আশ্বিনা আম আছে পর্যাপ্ত। স্থানীয় চাষীদের কাছ থেকেও আম কিনে থাকি। ফলে চাষীরাও লাভবান হন। কারণ চাষীদের হাটে আম নিয়ে গেলে খাজনা দিতে হয়। আবার দামও কম পান। আড়তদাররা আবার সেই আম বিক্রি করেন আম ব্যবসায়ীদের কাছে। সেই আম কয়েক হাত ঘুরে যেত ভোক্তার কাছে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীদের আমে ফরমালিন দিতে হয়। অনলাইনে বিক্রির ফলে সরাসরি বাগান থেকে আম প্যাকেট হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে যায়। ফলে টাটকা ফরমালিনমুক্ত সুস্বাদু মিষ্টি রসালো আম পেয়ে যান ভোক্তারা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ‘রাজশাহী ম্যাংগো প্যারাডাইস’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করেছেন। গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার মানুষ আমের অর্ডার করছেন। সে অনুসারে তারা আম সরবরাহ করছেন। গ্রুপের সদস্য ও গাজীপুরের বাসিন্দা নাদিম নিলয় বলেন, আমের গুটি হওয়ার পর থেকে সব আপডেট গ্রুপে জানিয়েছি। আম পরিপক্ব হওয়ার পর বাজার অনুসারে দাম ও ছবি দিয়ে আম বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে তিন টন আম অর্ডার হয়েছে। অর্ডার অনুযায়ী বাগানের গাছ থেকে পরিপক্ব আম নামিয়ে ক্যারেটে প্যাকিং করে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কুরিয়ারের মাধ্যমে আম সরবরাহ করছি। ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে নিলয় বলেন, করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় একেবারে বসে না থেকে কিছু করার চেষ্টা করছি। ঢাকায় বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী ফরমালিন দিয়ে আম নিয়ে আসেন যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই বিষয়টি ভেবে এলাকা ও পরিচিত মানুষকে ফরমালিন মুক্ত আম খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে এ ব্যবসা শুরু করা। আমরা বাগান থেকে ফ্রেশ ও বাছাইকৃত আম সরবরাহ করে থাকি। প্রথম চালান আম বিক্রির পর গ্রাহকরা বেশ সন্তুষ্ট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুর রহমান নিজ এলাকা কুমিল্লায় আম বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, রাজশাহীর বিখ্যাত সব আম এলাকায় চাহিদা আছে। চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই অবসর সময়ে মৌসুমি ফলের ব্যবসা শুরু করেছি। এতে এলাকার মানুষকে ফ্রেশ ও অরিজিনাল রাজশাহীর আম খাওয়াতে পারছি। সেসঙ্গে নিজেরও কিছু অর্থ আয় হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আম নামানোর সরকারী তারিখ অনুসারে আমের অর্ডার নিয়েছি। অর্ডার অনুসারে রাজশাহীর বন্ধুর বাগান থেকে যত্নের সঙ্গে এলাকায় আম নিয়ে আসছি। তারপর সবার কাছে আমগুলো ডেলিভারি করছি। আম পেয়ে এলাকার গ্রাহকরা এ বছর বেশ সন্তুষ্ট। রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম বলেন, গত বছর থেকে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গতবার ভাল লাভ হয়েছিল। প্রথমদিকে অনেকটা শখের বসেই চার বন্ধু মিলে অনলাইনে আম ডেলিভারি দেয়া শুরু করেছিলাম। পরে পেশাদারিত্ব এসেছে। অনেক অর্ডার পাচ্ছি। সময়মতো আম পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে আমের ব্যবসা ভালই লাভজনক। অনলাইনে আম কিনেছেন কক্সবাজারের মহিদুল হাসান। তিনি পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার এক আত্মীয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক বন্ধুর ফেসবুক এ্যাকাউন্ট দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। তার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। তারপর তারা আম পাঠিয়ে দেন। বিগত সময়ে বাজার থেকে আম কিনে খেয়েছি। তবে এবারের মতো স্বাদ কখনই পায়নি। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল বলেন, জেলায় এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। আমের উৎপাদনও ভাল হয়েছে। করোনায় অনেকে অনলাইনে আম ক্রয় করছেন। কুরিয়ারের মাধ্যমে আম পাঠানোটা একটা ভাল দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ট্রেনে আম পাঠানোর সুযোগ হওয়ায় ভাল হয়েছে।
×