ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের পাতায় ডেভন কনওয়ে

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ৯ জুন ২০২১

ইতিহাসের পাতায় ডেভন কনওয়ে

শচীন টেন্ডুলকরের ১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি, টেস্টে ব্রায়ান লারার অপরাজিত ৪০০, মুত্তিয়া মুরলিধরনের ৮০০ উইকেট- আরও কত কী। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব রেকর্ড বুঝি কখনোই ভাঙবে না। কিন্তু রেকর্ডের জন্মই যে ভাঙার জন্য। হয়ত একদিন এই রেকর্ডগুলোও ভেঙে যাবে। রেকর্ডের ভাঙাগড়া, নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়া ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডেভন কনওয়ের কথাই ধরা যাক। কে ভেবেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া ২৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান এমন এক কীর্তি গড়বেন টেস্টের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে যা আগে কেউ পারেনি। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে সাজঘরে ফেরার আগে করেছেন ঠিক ২০০ রান। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভিনদেশী কোন ব্যাটসম্যানের টেস্ট অভিষেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রেকর্ড এটি। দ্বিতীয় ইনিংসে আউট হয়েছেন ২৩ রান করে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ২২৩। যা ওপেনার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে দুই ইনিংস মিলিয়ে সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড। ‘কখনও ভাবিনি ইংল্যান্ডের মাটিতে অভিষেকে এমন একটা ইনিংস খেলতে পারব। এই অনুভূতি স্পেশাল।’ ড্র টেস্টে ম্যাচসেরার পুরস্কার গ্রহণের সময় বলছিলেন কানওয়ে। লর্ডসে কনওয়ে যা করেছেন তা সত্যি অনন্য। ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট অভিষেকে আগের সেরা ছিল সেই ১৮৯৬ সালে রণজিৎ সিংজির অপরাজিত ১৫৪। ম্যানচেস্টারে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনে নেমে ইনিংসটি খেলেছিলেন ভারতে জন্ম নেয়া এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান। ১৪৪ বছরের টেস্ট ইতিহাসে অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি এতদিন ছিল ছয় জনের। সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে তালিকায় যুক্ত হলেন কনওয়ে। ইনিংস শুরু করতে নেমে কনওয়ে প্রথম দিনেই সেঞ্চুরিতে পা রাখেন। লর্ডসে অভিষেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের নতুন রেকর্ড গড়ে দিন শেষে অপরাজিত থাকেন ১৩৬ রানে। দ্বিতীয় দিন একে একে সতীর্থদের বিদায়ের পরও এক প্রান্ত আগলে রাখেন তিনি। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে টিম সাউদি যখন ফেরেন, কনওয়ের রান ১৮৬। ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়া নিয়ে শঙ্কা। এগারো নম্বরে নেমে দারুণ কিছু শট খেলেন নেইল ওয়াগনার। ১৮৯ থেকে মার্ক উডকে বাউন্ডারি মেরে কনওয়ে এগিয়ে যান মাইলফলকের দিকে। ওই ওভারেই ৯৪ থেকে ছক্কা হাঁকিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৩৪৭ বলে। ছিল ‘ক্যারিং ব্যাট থ্রু আউট আ কমপ্লিটেড ইনিংস’ এর কীর্তি গড়ারও হাতছানি। তবে পরের ওভারে কাটা পড়েন রান আউটে। করেন ঠিক ২০০ রান। ৩৪৭ বলের ইনিংসটি গড়া ২২ চার ও এক ছক্কায়। টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তিটি প্রথম গড়েছিলেন টিপ ফস্টার। ১৯০৩ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই ইংলিশ ব্যাটসম্যানের ২৮৭ এখনও অভিষেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড। প্রায় সাত দশক পর ১৯৭২ সালে কিংসটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২১৪ রান করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের লরেন্স রো। কিউইদের বিপক্ষেই ১৯৮৭ সালে কলম্বোতে অপরাজিত ২০১ রানের ইনিংস খেলেন শ্রীলঙ্কার ব্রেন্ডন করুপ্পু। চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কীর্তি গড়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের ম্যাথু সিনক্লেয়ার, ১৯৯৯ সালে ওয়েলিংটনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২১৪। ২০০৩ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে অপরাজিত ২২২ রান করেন দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক রুডলফ। কনওয়ের আগে সবশেষ অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরির স্বাদ পান ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাইল মেয়ার্স। গত ফেব্রুয়ারিতে চতুর্থ ইনিংসে তার অপরাজিত ২১৪ রানের কাছেই হেরেছিল বাংলাদেশ। অভিষেক টেস্টে ওপেনার হিসেবে দুই ইনিংসে সর্বোচ্চ ২২৩ রানের পথে কনওয়ে ভেঙেছেন কেপলার ওয়েসেলসের রেকর্ড। ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ইংল্যান্ডে বিপক্ষে অভিষেকে তিনি করেছিলেন ২০৮ রান। প্রথম ইনিংসে ১৬২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬। বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসার পর ১৯৯৯ সালে নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলা ওয়েসেলস পরে দলকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা লায়ন্সের হয়ে ১২ ম্যাচ খেলে গড় মাত্র ২১.২৯। তাই ছয় বছর চেষ্টার পরও জায়গা পাকা হয়নি। হয়তো অনেকে ক্রিকেট ছেড়ে অন্যকিছুর চেষ্টা করতেন। কিন্তু কনওয়ে অন্য ধাতুতে গড়া, সিদ্ধান্ত নিলেন দেশান্তরী হবেন। সঙ্গী কিমও সায় দিলে একদিন সবকিছু পেছনে ফেলে উঠে বসলেন ওয়েলিংটনের প্লেনে। ওয়েলিংটনে এসে খোঁজ পেলেন ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট ক্লাবের। নতুন দেশে এসে নতুন করে যেন সবকিছু শুরু করলেন কনওয়ে, রানের বন্যা বইয়ে দিলেন ভিক্টোরিয়ার হয়ে। ফলাফল পেতেও অপেক্ষা করতে হয়নি, ডাক পেয়ে গেলেন ওয়েলিংটন প্রাদেশিক দলে। টম ব্লান্ডেল জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায় সুবাদে তিন ম্যাচের জন্য সুযোগ পেলেন ওয়েলিংটন দলে। অভিষেকে ৩০-এর কিছু বেশি, দ্বিতীয় ম্যাচে ৭৪ বলে ৭৮ আর তৃতীয় ম্যাচে লোকি ফার্গুসনের দলের বিপক্ষে দ্রুতগতির ৫০ তিন ম্যাচের ওই অগ্নিপরীক্ষায় কনওয়ে খারাপ করেননি খুব একটা। কনওয়ের ভাগ্যলিপিটাও সম্ভবত লেখা হয়ে গিয়েছিল ওই তিন ম্যাচের পর। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি, সেখানেই ব্যাট করেছেন রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন। ফোর্ড ট্রফিতে ৯ ম্যাচে ৫৫.৩০ গড়ে ৫৫৩ রান এবং টি২০তে সুপার স্ম্যাশে ৬৭.৮৩ গড়ে ৫৪৩ রান করেন। অবশেষে টি২০ দিয়ে ডাক পান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলে। দলকে জেতাতে ভূমিকা রাখেন, দ্বিতীয় ম্যাচেও ফিফটি, ৩৭ বলে ৬৫ রানে নট আউট। এ পর্যন্ত ১৪ টি২০ ম্যাচে প্রায় ৬০ গড়ে করেছেন ৪৭৩ রান। হাফ সেঞ্চুরি ৪টি। গত মার্চে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক ম্যাচে বেশি করতে পারেননি, লো স্কোরিং ম্যাচে ২৭ রান করে ফিরে যান। পরের দুই ম্যাচে ফিফটি (৯৩ বলে ৭২) ও সেঞ্চুরি (১১০ বলে ১২৬) করে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে যান, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান যার, তার চেয়ে ১০৭ বেশি রান করেন। তিন ম্যাচে ৭৫ গড়ে ২২৫ রান করে সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনি। ধারাবাহিকভাবে রান করে গেছেন প্লাংকেট শিল্ডেও, শেষ মৌসুমে ওয়েলিংটনের হয়ে ১০ ইনিংসে ৮৭.৬২ গড়ে করেছেন ৭০১ রান। ক্যান্টাবুরির বিপক্ষে খেলেন ৩২৭ রানের অনবদ্য ইনিংস। অতঃপর সুযোগ পেলেন টেস্টে। লর্ডসে গড়লেন নতুন ইতিহাস।
×