ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগারে সাংবাদিক রোজিনা, কাল জামিন শুনানি

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৯ মে ২০২১

কারাগারে সাংবাদিক রোজিনা, কাল জামিন শুনানি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে জামিন দেয়নি আদালত। শাহবাগ থানা মঙ্গলবার সকালে তাকে সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে। সেখানে জামিনের আবেদন করলে তা নাকচ করে হাজতে প্রেরণ করে আদালত। একইসঙ্গে পুলিশের রিমান্ডের আবেদনও খারিজ করে দেয় আদালত। বাংলাদেশ সচিবালয় রিপোর্টার্স ফোরাম মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিং এবং রোজিনার জামিন না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন ঘটনার সংবাদ বর্জনসহ বেশকিছু কর্মসূচী দিয়েছে। রোজিনাকে হেনস্তার ব্যাখ্যা চেয়ে স্বাস্থ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী ডাঃ মোঃ শিব্বির আহমেদ ওসমানীর দফতর বদলি করা হয়েছে। সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম জামিন পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মঙ্গলবার দুপুরে প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে মন্ত্রী এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা তথ্য চুরির মামলায় অভিযুক্ত রোজিনা ইসলামকে মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে সিএমএম আদালতে নিয়ে আসা হয়। এরপর শাহবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক আরিফুর রহমান সরদার আসামির পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বেলা ১১টার একটুপরে রোজিনাকে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেয়া হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম তার রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আগামী বৃহস্পতিবার তার জামিনের শুনানি হতে পারে। আদালতের আদেশের পর সিএমএম আদালত থেকে প্রিজনভ্যানে করে রোজিনাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের করোনাকালীন কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ডে (রজনীগন্ধা ভবন) রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে। আদালতে রোজিনার পক্ষে শুনানি করেন প্রথম আলোর নিয়োজিত আইনজীবী এহসানুল হক সামাজি, আশরাফ উল আলম ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার। এছাড়া, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে আইনজীবী আব্দুর রশীদ, ব্লাস্টের পক্ষে আইনজীবী মশিউর রহমান এবং আইনজীবী সুমন কুমার রায় শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু। এর আগে বেলা ১১টায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে উপস্থিত হয় বিএসআরএফ ও স্বাস্থ্য বিটের সাংবাদিকরা। সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিব যথাসময়ে সভাকক্ষে আসেন। অন্যান্য সংবাদ সম্মেলনে দেরিতে আসলেও মঙ্গলবার তারা যথাসময় উপস্থিত হন। তখন বিএসআরএফ নেতৃবৃন্দ মন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, সোমবার দুপুরে এই ঘটনার পর বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আমরা আপনার সচিবের (স্বাস্থ্য সচিব) সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার অনুরোধ জানিয়েছি। তখন আপনারা কেউ আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেননি। আলোচনায় বসার দাবি বার বার উপেক্ষা করেছেন। নেতৃবৃন্দ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও আপনারা তাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেননি। তাই আমরা আপনার সংবাদ সম্মেলন বয়কট করছি। এই বলে একে একে সকল সাংবাদিক সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় স্বাস্থ্য বিটে কর্মরত সাংবাদিকরাও এই কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে রোজিনা ইসলামকে হয়রানি ও তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার প্রতিবাদে সচিবালয়ে গণমাধ্যম কেন্দ্রে এক জরুরী সভায় বসে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ)। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএসআরএফের সভাপতি তপন বিশ্বাস। সভাটি সঞ্চালনা করেন বিএসআরএফের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ। এ সময় বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভায় রোজিনা ইসলামকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের (পিএস) কক্ষে সাড়ে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন এবং পুলিশের কাছে সোপর্দের পর মামলা দেয়ায় ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানানো হয়। অবিলম্বে মামলা প্রত্যাহার করে রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ারও দাবি জানানো হয় সভায়। সভা থেকে ঘোষণা করা হয় পরবর্তী কর্মসূচী। সভায় বলা হয়, রোজিনা ইসলামকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। প্রত্যাহার করতে হবে দায়ের করা মামলা। লাঞ্ছিত করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব দাবি আদায়ের জন্য আজ বুধবার বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হবে। জামিন না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের ব্রিফিং বর্জন করা হবে। সভায় রোজিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হেনস্তার প্রতিবাদে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সাংবাদিকদের মূল সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচী দেয়া হবে। রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে তথ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। বিএসআরএফের বিবৃতিতে বলা হয়, একজন স্বনামধন্য ও পেশাদার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও তার অধীনস্থ ব্যক্তিদের এ আচরণ মুক্তমত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী। যা দেশের গণতন্ত্র ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাভাবিক গতিকে চরমভাবে ব্যাহত করবে। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং গণতন্ত্রের গতি স্বাভাবিক রাখতে অবিলম্বে রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিএসআরএফ-এর পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও দেশের উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত শেষে জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা তাকে জানিয়েছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোজিনাকে ৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছে। তাকে নানা ধরনের হেনস্তা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চেয়েছি। এ ধরনের হেনস্তা করার অধিকার কারও নেই। এরা কারা, কি জন্য করেছে সেটার তদন্ত করে বিচার করতে হবে। ওনার জামিনের বিষয়ে বলেছি যেন জামিন হয়। সবচেয়ে বড় যেটা তিনি অসুস্থ, তাকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার বিষয়ে বলেছি। তিনি আরও বলেন, যেহেতু কারাগারে পাঠানো হয়েছে আমরা জানি কারাগারের কি অবস্থা। তাকে যেন ভাল পরিবেশে রাখা হয়। তাকে যেন সেখানে নতুন করে কোনভাবে হ্যারেজ না করা হয়, সেটা যাতে নিশ্চিত করা হয়। উনি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেছেন, ওনারা সাধ্যমতো দেখবেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন বৃহস্পতিবার যে জামিন শুনানি হবে সেখানে তার জামিন হয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটাও বলেছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারের ভুল বোঝাবুঝি হোক এটা তারা চায় না। ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, তারা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) যেহেতু মামলা করেছে রোজিনা ইসলাম কি অপরাধ করেছে সেটি আদালত দেখবেন। কিন্তু তারা যে হেনস্তা করেছে সেটি করতে পারে কি-না তা তদন্ত করে দেখার জোরালো দাবি জানিয়েছি। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, আমরা জানতে পেরেছি রোজিনা ইসলামকে শারীরিক টর্চার করা হয়েছে। আমরা সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছি। তারা বলেছে আধাঘণ্টা পর পুলিশে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মূলত কয়েক ঘণ্টা তাকে ছোট একটি রুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মানসিক ও শারীরিকভাবে তাকে বিভিন্ন ধরনের হেনস্তা করা হয়েছে। সেটি যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা বলেছি রোজিনা ইসলামের নামে যে দুটি ধারায় মামলা হয়েছে সে দুটি ধারায় জামিনযোগ্য। সেখানে কিন্তু রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাওয়া হয়েছে। যাতে জামিন না হয় সেজন্য এটা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তিনি আশা করেন বৃহস্পতিবারের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে। কোন প্রকার ব্যত্যয় না করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে যেন জামিন হয় আমরা সে দাবি করেছি। এছাড়া রোজিনা যাতে সুবিচার পান সে বিষয়ে তারা সচেষ্ট থাকবেন। মানবাধিকার কমিশনের চিঠি ॥ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। একইসঙ্গে ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা চেয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে কমিশন। চিঠিতে বলা হয়, গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি, অনুমতি ছাড়া করোনার ভ্যাকসিনের সরকারী নথির ছবি তোলার অভিযোগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখে হেনস্তা করা হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, দীর্ঘ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে একজন সাংবাদিককে আটক রাখার বিষয়টি নিন্দনীয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, রোজিনা ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা না করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়, যা অমানবিক বলে কমিশন মনে করে। মহিলা পরিষদের দাবি ॥ রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার প্রতিবাদ এবং তার মুক্তির দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ডাঃ ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বিবৃতিতে বলেন, আমরা গভীর বিস্ময় ও উদ্বেগের সঙ্গে জানতে পারলাম, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়েছে। তাকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় একজন নারী সাংবাদিকের ওপর সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি ও তার সুচিকিৎসার দাবি জানানো হয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে মহিলা পরিষদ। মামলার বাদীর দফতর বদল ॥ সরকারী নথি সরানোর অভিযোগে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী ডাঃ মোঃ শিব্বির আহমেদ ওসমানীর দফতর বদলি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ মে) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক অফিস আদেশে এ কথা জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানের সই করা অফিস আদেশটি মঙ্গলবার জারি করা হলেও তাতে তারিখ দেয়া হয়েছে সোমবারের (১৭ মে)। মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে শিব্বির আহমেদ ওসমানীকে জনস্বাস্থ্য-১ অধিশাখা থেকে জনস্বাস্থ্য-২ অধিশাখায় বদলি করা হয়েছে। একই অফিস আদেশে আরও পাঁচজনকে দফতর বদলির কথা জানানো হয়।
×