ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা বলেও আদালতে গিয়ে বাবুলের না

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৮ মে ২০২১

স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা বলেও আদালতে গিয়ে বাবুলের না

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রিমান্ড শেষে আদালতে গিয়ে মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাবেক এসপি বাবুল আক্তার আবারও নতুন নাটকের জন্ম দিলেন। রবিবার পর্যন্ত ৫ দিনের রিমান্ডে পিবিআইর তদন্ত টিমের কাছে তিনি অনেক কিছু স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্ত্রী মিতুকে হত্যা করিয়েছেন একথা ঘুণাক্ষরেও মুখ থেকে বের করেননি। তবে শেষ মুহূর্তে স্বীকারোক্তি দেবেন বলে আশ্বস্ত করায় বাবুল আক্তারকে সোমবার মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহানের খাস কামরায় নেয়া হয়। আইনের নিয়ম অনুযায়ী বাবুল আক্তারকে নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সবশেষে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার নাটকের অবসান ঘটে। বাবুল আক্তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দিলে তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার পর পিবিআই সূত্রে জানানো হয়েছে, বাবুল আক্তার তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যে আশ্বাস দিয়ে আদালতে গিয়েছিলেন, সেখানে ঠিক উল্টোটাই করলেন। মূলত ২০১৬ সালের ৫ জুন স্ত্রী মিতু হত্যাকা-ের পর থেকে বাবুল আক্তার নানা প্রক্রিয়ায় নাটক করেই যাচ্ছিলেন। যে কারণে একটি সত্য ঘটনা উদ্ঘাটনে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু থানায় মামলার পর তদন্তভার আসে সিআইডিতে। সিআইডি বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়। এরপর মামলাটি অধিগ্রহণ করে পিবিআই। পিবিআইর চট্টগ্রাম মেট্রো বিভাগে এ মামলার তদন্তের প্রথম দায়িত্ব পান তৎকালীন এসপি মোঃ মাঈনউদ্দিন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেলে তদন্তের দায়িত্ব পান ইন্সপেক্টর সন্তোষ কুমার চাকমা। এরই মাঝে এ মামলার ধীরগতি নিয়ে উচ্চ আদালত ও নি¤œ আদালত পিবিআইকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানোর নির্দেশও প্রদান করে। মামলার আদ্যোপ্রান্ত আদালতকে জানিয়ে বৃহত্তর তদন্তের সময়ের প্রয়োজন বলে অবহিত করা হয়। গত ১২ মে নাটকীয়ভাবে মিতু হত্যার প্রথম মামলাটি যেটার বাদী ছিলেন বাবুল আক্তার সেটার ফাইনাল রিপোর্ট হয় এবং এর একঘণ্টার মধ্যে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নতুন মামলা দায়ের করলে সেই মামলায় বাবুলকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং তাকে শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে ওইদিনই আদালতে সোপর্দ করে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। রিমান্ড শুরু হয় ১২ মে থেকে। চারটি টিমে বিভক্ত পিবিআইর কর্মকর্তারা বাবুল আক্তারকে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদে কয়েকটি বিষয় তিনি স্বীকার করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ঘটনার পর পর তারই সোর্স মুসাকে তিনি চেনেন না বলে জানিয়েছিলেন। এই মুসাই মিতুকে হত্যার মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে। রিমান্ডে তদন্ত কর্মকর্তাদের উপর্যুপরি প্রশ্নের উত্তরে শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করেছেন মুসা তার প্রধান সোর্স ছিল। তবে মুসা এখন কোথায় আছে তিনি তা জানেন না। এছাড়া বিবাহিত জীবনে মিতুর সঙ্গে তার সম্পর্ক যে ভাল ছিল না সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন। কক্সবাজারে এনজিও কর্মকর্তা গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেটাও স্বীকার করেছেন। এছাড়া আরও স্বীকার করেছেন তিনি তার ব্যবসায়িক পার্টনার সাইফুলকে ৩ লাখ টাকা একজনকে দিতে হবে বলেছিলেন। এই একজনই হলেন তার সোর্স মুসা। কেন দিয়েছিলেন এর উত্তরে বলেছেন, পুলিশে সোর্সদের টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়। সে লক্ষ্যেই তিনি বিভিন্ন সময়ে মুসা এবং অপরাপর সোর্সদের টাকা প্রদান করতেন। তদন্তে বাবুল তার প্রেমিকা গায়ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার সি বিচে, রামুর রাবার বাগানে, দুবাই শহরে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু একবারের জন্যও স্বীকার করেননি স্ত্রী মিতুকে তিনি পরিকল্পিতভাবে হত্যা করিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, মিতুকে তিনি ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া তার মা তাকে আরেকটি বিয়ে করানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এসব নিয়েই তার সংসার জীবন এগোচ্ছিল। কিন্তু তা একেবারেই খারাপের চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। যে কারণে একই ঘরের ছাদে তারা আলাদাভাবে থাকতেন। রিমান্ডে তাকে মিতু হত্যায় যে তিনি জড়িত, তার নির্দেশে, পরিকল্পনায় এবং অর্থায়নে যে এ হত্যাকা- ঘটেছে এসবের সামঞ্জস্যপূর্ণ সব ধরনের এনালগ, ডিজিটাল প্রমাণসমূহ দেখানো হয়। কিন্তু এরপরও তিনি মুখ থেকে বলেননি যে, তিনিই স্ত্রীকে হত্যা করিয়েছেন। রবিবার রিমান্ডের শেষ দিনে তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিলেন, তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবেন। যা বলার সেখানেই বলবেন। পিবিআইর সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এটা ছিল বাবুলের আরেকটি নতুন নাটক। রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় কড়া নিরাপত্তায় বাবুলকে চট্টগ্রাম আদালতে নেয়া হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহানের খাস কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় সরাসরি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর আগে আসামিকে প্রায় তিনঘণ্টা সময় দেয়া হয় চিন্তা ভাবনা করে সত্য বলার জন্য। বাবুল আক্তারের ক্ষেত্রে সেটাই অনুসরণ করা হয়েছে। স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য তিনি রাজি একথা বিশ্বাসে রেখে কক্ষের বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন পিবিআইর কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমকর্মী এবং উৎসুক অনেকে। বিকেল ৩টার আগে ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহান জানিয়ে দিলেন বাবুল আক্তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ডিকলাইন করেছেন। ফলে তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেয়া হয়। বেলা তিনটায় বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব ঘটনার পর যোগাযোগ করা হলে পিবিআইর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা জনকণ্ঠকে জানালেন, সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তিনি আমাদেরকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবেন বলে আদালতে গেছেন। কিন্তু নাটকীয়তার সঙ্গে ডিকলাইন করলেন। পরবর্তী প্রক্রিয়া কি হবে জানতে চাইলে নাঈমা সুলতানা জানান, আজকালের মধ্যে পিবিআইর পক্ষ থেকে বাবুল আক্তারকে আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে। আদালত গ্রহণ করলে পুনরায় এ রিমান্ড প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাবুল আক্তারের এমন নাটকীয় ঘটনায় পিবিআইর কর্মকর্তারা রীতিমতো হতবিহ্বল। অনেকে বলেছেন, তিনি একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার ছিলেন। এছাড়া তিনি ক্রাইম বিষয়াদি নিয়ে কাজ করতেন। ফলে তিনি জানেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলে এর ফল কি দাঁড়াবে। ফলে তিনি আবারও নতুন করে নাটকের জন্ম দিলেন। অপরদিকে, পিবিআইর শীর্ষস্থানীয় আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য প্রমাণে পরিষ্কার যে, মিতুকে তিনি ভাড়াটিয়া খুনী দিয়ে হত্যা করিয়েছেন। মিতু হত্যা সংঘটিত হয় ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে। দুই মিনিটের মধ্যে কিলিংয়ে নেতৃত্বদানকারী সন্ত্রাসী মুসা বাবুল আক্তারকে মোবাইল ফোনে জানান, ‘স্যার ডান (অর্থাৎ কাজ হয়ে গেছে)।’ ঘটনার পর ঢাকায় ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল জানিয়েছিলেন মিতু যে খুন হয়েছেন তিনি তা প্রথম জেনেছেন বাসার গৃহকর্মীর টেলিফোনে। পরে আবার বলেছেন তার বাড়িওয়ালাই তাকে প্রথম ঘটনা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, বাবুল আক্তার সপরিবারে চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোডের একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে প্রথম ফোনটি ছিল মুসার। কিন্তু রিমান্ডে তিনি তা বার বার এড়িয়ে গেছেন। এখানে উল্লেখ্য, সাধারণত পুলিশী রিমান্ডে আসামিদের যে প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুল আক্তারের ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। জিজ্ঞাসাবাদে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা কর্মজীবনে তার জুনিয়র ছিলেন বিধায় সকলেই তাকে স্যার সম্বোধন করে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেননি। মিতু হত্যাকা-ের পূর্বাপর সব তথ্য প্রমাণ তার সামনে উপস্থাপন করা হলেও তিনি যে হত্যা করিয়েছেন তা নিয়ে মুখ খোলেননি। যা বলবেন আদালতে বলবেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়ে ডিকলাইন করে বসলেন। পিবিআই সূত্রে জানানো হয়, শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন বা না দেন তিনিই যে এ হত্যাকা-ের প্রকৃত রূপকার সেটা সন্দেহাতীতভাবে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে অন্য আসামি এবং সাক্ষীর জবানবন্দী রয়েছে। শুধু নিখোঁজ রয়েছে কিলিং স্কোয়াডে নেতৃত্বদানকারী বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স মুসা। এক্ষেত্রে আগামীতে এ ঘটনা নিয়ে চার্জশীট প্রদানে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বলে পিবিআই মনে করে।
×