ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশেই তৈরি হবে রাশিয়ার করোনার টিকা

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ২৩ এপ্রিল ২০২১

দেশেই তৈরি হবে রাশিয়ার করোনার টিকা

অপূর্ব কুমার ॥ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় লকডাউনসহ কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলার সরকারী নির্দেশনার পাশাপাশি ভ্যাকসিন দেয়ার বিষয়ে তৎপরতার অংশ হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। ভারতের করোনা প্রকোপ বাড়ায় সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে ধোঁয়াশার কথা মাথায় রেখে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টার শুরুতেই সফলতা মিলল। যদিও ভারতের ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী আশ্বস্ত করেছেন, ভারত বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ভ্যাকসিন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি এবং ভারত আশ্বস্ত করার পর স্বস্তি ফিরেছে স্বাস্থ্য খাতে। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, করোনা টিকা ‘স্পুুটনিক ভি’ উৎপাদনে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সমঝোতা চুক্তি সই করেছে। এছাড়া চীন বাংলাদেশকে ৫ লাখ টিকা উপহার দেবে। বৃহস্পতিবার নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টিকা উৎপাদনে সই হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করতে পারব। তবে যে কোম্পানি টিকা উৎপাদন করবে, তাকে ফর্মুলা গোপন রাখতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনে সক্ষম এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা রাশিয়াকে দেয়া হয়েছে। এখন রাশিয়া এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে এ ফর্মুলা দিতে পারে। রাশিয়া যৌথভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত টিকা তৃতীয় দেশে রফতানির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি কবে সই হয়েছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই চুক্তি ইদানীং হয়েছে। বিভিন্ন রকমের আনুষ্ঠানিক দলিলে সই করেছি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যৌথ উৎপাদনের বিষয়ে চুক্তিটা হয়েছে। রাশিয়া থেকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা কেনা হবে কি না, জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের জন্য তো সময় লাগবে। জরুরী ভিত্তিতে যে টিকা লাগবে, সেটা তাদের কাছ থেকে কেনা হবে। চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশ তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতে ব্যাপকহারে করোনার প্রকোপ বাড়ায় সেখানে ১৮ বছরের উর্ধে সবাইকে টিকা দেয়ার প্রস্তাবের কারণে টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। গত বুধবার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনেওয়ালা জানিয়েছেন, আগামী জুন-জুলাইয়ের আগে রফতানির টিকা উৎপাদন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির বরাতে জানা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের এই সিইও এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যে আগামী দুই মাস তারা টিকা রফতানির কথা ভাবছেন না। আগামী জুন-জুলাইয়ে তারা সম্ভাব্য স্বল্প পরিমাণ টিকা রফতানি শুরু করতে পারবেন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, এখন আমরা দেশের প্রয়োজন অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষে টিকা বিকল্প খোঁজা ছাড়া উপায় ছিল না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই রাশিয়ার টিকা উৎপাদনে চুক্তি সই সরকারকে স্বস্তি এনে দিল। এর আগে সহ-উৎপাদন ব্যবস্থার আওতায় দেশের স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় রাশিয়া তাদের ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছিলেন। ড. মোমেন বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি রফতানি করার মতো পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা না থাকায় মস্কো বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই অনুসারে চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে রাশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে আর দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ‘স্পুুটনিক ভি’ উৎপাদন করবে। এটা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হবে এবং আশা করা যায় যে, এটা অপেক্ষাকৃত ভাল হবে। এদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ টিকা কিনেছে তার চালান না আসায় টিকাদান কর্মসূচী নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত বছরের পাঁচ নবেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে তিন কোটি ডোজ টিকা রফতানি করবে। সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা পায়নি। এ অবস্থায় দেশে টিকার যে মজুত রয়েছে, তা সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের জন্য তাগাদা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটিকে কিভাবে দ্রুততার সঙ্গে বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করা যায় সেই বিষয়ে সুপারিশ জমা দিতেও বলেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গত সোমবার এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টার কথাও বলা হয়েছিল। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মন্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন না থাকায় বাংলাদেশ এর আগে চীনের ভ্যাকসিনের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। ‘কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা ভ্যাকসিনটি পেতে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, যদিও, চীন বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে-তারা ইতোমধ্যেই তাদের ভ্যাকসিনটি অন্যান্য দেশে সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেয়ায়, ডিসেম্বরের আগে তারা আর কোন ভ্যাকসিন রফতানি করতে পারবে না। মোমেন বলেন, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশকে আগামী মাসে ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেবে বলে জানিয়েছে। আমরা কোভ্যাক্সের আওতায় ওই ভ্যাকসিনগুলো পাবো বলে আশাবাদী। প্রসঙ্গত, অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত বছরের পাঁচ নবেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে তিন কোটি ডোজ টিকা রফতানি করবে এবং সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত ভারত থেকে টিকা এসেছে মোট এক কেটি দুই লাখ ডোজ। এর মধ্যে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত ২১ জানুয়ারি প্রথমে আসে ২০ লাখ ডোজ। সরকারের অর্থে কেনা টিকার প্রথম চালানে ২৫ জানুয়ারি আসে ৫০ লাখ ডোজ, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ আসে আরও ২০ লাখ ডোজ এবং সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ আসে ১২ লাখ ডোজ। অর্থাৎ ভারত থেকে কেনা ও উপহার মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট টিকা এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ। দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়। গত ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ। তবে ভারত থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য চুক্তির ৩০ লাখ এবং মার্চ মাসের ৫০ লাখ অর্থাৎ চুক্তির ৮০ লাখ টিকা এখনও দেশে আসেনি। এপ্রিল মাসে টিকা আসার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত নেই। তবে ভারত সরকারের উপহারস্বরূপ ৩২ লাখ টিকা বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, দেশে এখন মজুত টিকা রয়েছে ২৪ লাখের মতো। আর দ্বিতীয় ডোজ নেয়া বাকি রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা যদি বর্তমান হারে চলতে থাকে, তাহলে মজুত টিকা ফুরিয়ে যাবে আগামী ১৫ দিন বা এক মাসের মধ্যে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সরবরাহে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে ॥ বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে ভারতের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। বৃহস্পতিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। চার দিনের ছুটি শেষে এদিন ভারত থেকে সড়ক পথে তিনি ঢাকায় ফিরছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, এখন সবার সামনে যে সমস্যা আছে, আমরা সবাই মিলে কাজ করে এই সঙ্কট মোকাবেলার চেষ্টা করছি। দ্বিতীয় ঢেউ খুব বড় ঢেউ এবং ভারতের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে খুবই কঠিন। আমরা সবাই কাজ করছি। দেখা যাক, দুই দেশের জনগণের সার্বিক মঙ্গলের জন্যে পারস্পরিক সহযোগিতা চালিয়ে যেতে আমরা কতটা চেষ্টা করে যেতে পারি। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ভ্যাকসিন সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। যে পরিমাণ সরবরাহ আছে সেটা নিয়ে আমরা সবাই ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। দেখা যাক, আমরা কতটা সহায়তা করতে পারি। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আওতায় পেয়েছে আরও ৩৩ লাখ ডোজ। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে আমরা ভ্যাকসিন সরবরাহের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ‘আমাদের কাছে যে পরিমাণ আছে, তার বেশি দেয়া সম্ভব না। ভারতেও বর্তমানে ভ্যাকসিনের বড় ঘাটতি রয়েছে। প্রতিটি বড় শহরেই ভ্যাকসিন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংখ্যক ভ্যাকসিন গ্রহণ করছে। অন্য কোন দেশকে এই পরিমাণ ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি। বাংলাদেশকে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের যে পরিমাণ ভ্যাকসিন সরবরাহ করার সুযোগ থাকবে, আমরা নিশ্চয়ই তা সরবরাহ করব। এই প্রতিশ্রুতি আগেও দেয়া হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।
×