ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শীঘ্রই শুনানি

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ১৩ এপ্রিল ২০২১

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শীঘ্রই শুনানি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপীল বিভাগের দেয়া পুরো রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদনের শুনানি শীঘ্রই অনুষ্ঠিত হবে। এমনটি আশাবাদ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনকর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে আপীল বিভাগ। আপীল বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন শুনানির উদ্যোগ নেবে রাষ্ট্রপক্ষ। সোমবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এ তথ্য জানান। এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, নিয়মিত আদালত খুললেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে আপীল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। আমরা দ্রুত শুনানির জন্য নিয়মিত আদালতে আবেদন করব। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই আবেদন দায়েরের পর কেটে গেছে তিন বছরেরও বেশি সময়। রিভিউ আবেদনটি এখনও আপীল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। অসামর্থ্যতা ও অযোগ্যতার কারণে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে সংশোধনীটি করা হয় ২০১৪ সালে। এর আগে এ ক্ষমতা ছিল সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এর পর সংশোধনীটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন নয় আইনজীবী। পরে হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশোধনীটি বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করে। আপীল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে দেয়া রায় ২০১৭ সালে বহাল রেখে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করেন। আপীল বিভাগের রায়ে দেয়া কিছু পর্যবেক্ষণ তখন দেশের রাজনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। সে সময় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগের দাবিও তোলে একটি পক্ষ। এমনই এক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে। ৯০৮ পৃষ্ঠার এই রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে। রায়ে দেয়া কিছু আপত্তিকর পর্যবেক্ষণকে অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানায়। বিশেষ করে ‘ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য ন্যাশনের স্থলে ফাউন্ডিং ফাদার’স অব দ্য কান্ট্রি’, ‘আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে, জনগণ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা অর্পণ করতে পারছে না’, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী’; ‘আমাদের অবশ্যই এই নোংরা ‘আমাদের লোক’ মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী ‘আমি একাই সব’ দৃষ্টিভঙ্গি’- রায়ের এসব পর্যবেক্ষণ বাতিলের দাবি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপীল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। এর আগে ওই বছরের ৮ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপীল শুনানি হয়। ধারাবাহিকভাবে টানা ১১ দিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আপীল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ এ্যামিকাস কিউরির মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর ৯ এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন এ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন। এর আগে ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপীল শুনানিতে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ দেন আপীল বিভাগ। ২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেছিলেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের এ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। আদালত রায়ে আরও বলে, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের বিরুদ্ধে সাংসদেরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। তাদের নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সাংসদদের সবসময় দলের পক্ষে থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা আছে। রায়ে আরও বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল। মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন চলে আসবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করবে- এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করে।
×