ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার দাপট বাড়ছেই

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৮ এপ্রিল ২০২১

করোনার দাপট বাড়ছেই

শরীফুল ইসলাম ॥ দেশে দিনদিনই বাড়ছে করোনার দাপট। এ কারণে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বেই এখন করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বিগত এক সপ্তাহে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। আর দেশে বুধবার করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৬২৬ জন। যা দেশে একদিনে করোনা শনাক্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও একদিনে সোয়া লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এদিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশের মানুষ সরকার ও বিশেষজ্ঞসহ কারও কোন পরামর্শই শুনতে চাচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষই মানছেন না কোন স্বাস্থ্যবিধি। অপরদিকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগী ভর্তির সুযোগ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে কোন হাসপাতালেই আইসিইউ খালি নেই। সবকিছু মিলিয়ে দেশে করোনা পরিস্থিতির চরম বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সারাদেশে লকডাউন ও ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করলেও সাধারণ মানুষ তা অনুসরণ করার ব্যাপারে উদাসীন। পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা দূরে থাক মাস্কই ব্যবহার করতে চাচ্ছে না মানুষ। অনেকেই যুক্তির বিপরীতে খোঁড়াযুক্তি দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রথম দফা করোনা টিকা গ্রহণ করেই অবাধে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এভাবেই করোনা নিয়ে তামাশা করছেন এক শ্রেণীর মানুষ। আবার করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ যখন অক্সিজেন ও আইসিইউ খুঁজে ব্যর্থ হচ্ছে তখন এই শ্রেণীর মানুষই প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন? কি অদ্ভুত এদের চরিত্র! দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চিকিৎসাসেবা এখন চরম সঙ্কটের মুখে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে রোগীদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু হাসপাতালে বেড ও আইসিইউ খালি না থাকায় হাসপাতালে গিয়ে করোনা রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কোন রোগী হাসপাতাল থেকে বের হলেই কেবল নতুন রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ বিষয়ে বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক আহমেদুল কবির জানান, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেহাল দশা চলছে। হাসপাতালে করোনা রোগীদের স্থান দেয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার গণপরিবহন চলছে। করোনা সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিতে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এ বিষয়ে বুধবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। রোগীর চাপ এতটাই বেড়েছে অনেকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেনও না। তবে আমরা প্রায় সব হাসপাতালে বেড বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আর সাধারণ রোগী কমিয়ে করোনা রোগীদের বেশি বেডের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। আগের দিন মহাখালী ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যেভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তাতে পুরো শহরকে যদি হাসপাতাল করা হয় তাহলেও করোনা রোগীদের স্থান দেয়া যাবে না। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়। এর ফলে দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৪৭ জনে। দেশে বুধবার নতুন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৬২৬ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৮ জনে। আগের দিন মঙ্গলবার দেশে একদিনে ৭ হাজার ২১৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বুধবারসহ টানা চারদিন দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৭ হাজারের বেশি। যা দেশের জনগণের জন্য চরম দুঃসংবাদ। এদিকে বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১৩ কোটি ৩০ লাখ ৩৪ হাজার ৪২০ জন মানুষ। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৬ জন। সুস্থ হয়েছে ১০ কোটি ৭২ লাখ ৮৯ হাজার ১৭৮ জন মানুষ। সারাবিশ্বে বর্তমানে সক্রিয় রোগী রয়েছেন ২ কোটি ২৮ লাখ ৫৮ হাজার ৯৯৬ জন। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এখনও পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৪৩৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৫ লাখ ৭০ হাজার ২৬০ জন। করোনা আক্রান্তের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল। ওইদেশে মোট আক্রান্ত ১ কোটি ৩১ লাখ ৬ হাজার ৫৮ জন এবং মারা গেছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৪ জন। বুধবার ব্রাজিলে একদিনেই মারা গেছে সোয়া ৪ হাজার মানুষ। বিশে করোনা আক্রান্তের দিকে ৩য় অবস্থানে থাকা ভারতে মোট আক্রান্ত ১ কোটি ২৮ লাখ ১ হাজার ৭৮৫ জন এবং মারা গেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ২০৮ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ একদিনে আক্রান্ত হয়েছে সোয়া লাখ মানুষ। বিশ্বে করোনাক্রান্ত দেশের মধ্যে এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, তুরস্ক, স্পেন, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ। করোনাভাইরাসে সংক্রমণ মৃত্যুর দিক থেকে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম স্থানে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানলে শীঘ্রই বাংলাদেশে করোনা পরিস্থির উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সরকারের সার্বিক ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়লেও এখনও অনেকেই তা ব্যবহার করছে না। মাস্ক ছাড়াই তারা কাঁচাবাজার করতে যাওয়াসহ এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া লকডাউনের পর বিভিন্ন মার্কেটের সামনে দোকানিরা বিক্ষোভ করে দোকান খোলার অনুমতি প্রদানের দাবি জানাচ্ছে। করোনা সংক্রমণের হটস্পট হচ্ছে কাঁচাবাজার। লকডাউনের মধ্যেও সরকারী নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কাঁচাবাজারগুলোতে। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধিও। ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। রাজধানীসহ সারাদেশের অধিকাংশ কাঁচাবাজারেই গাদাগাদি করে ত্রেতারা কেনাকাটা করছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর এসব কাঁচাবাজারে পরস্পরের গা ঘেঁষে চলাফেরা করতে হচ্ছে। কাঁচাবাজারগুলোতে এক পথে প্রবেশ করে আরেক পথে ক্রেতাদের বের হওয়ার কথা থাকলেও কেউ তা মানতে চাচ্ছেন না। আবার অনেক কাঁচাবাজারে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য আলাদা পথ নেই। এর ফলে বাজার করতে যাওয়া কারও সংক্রমণ হয়ে থাকলে তা সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকে। গতবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় কাঁচাবাজারগুলো খোলা জায়গায় সরিয়ে নেয়ার জন্য। তখন কোন কোন কাঁচাবাজার খোলা জায়গায় সরিয়ে নিলেও করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। সম্প্রতি সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনায় সকল কাঁচাবাজার খোলা জায়গায় সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও এখনও এ নির্দেশ মানা হচ্ছে না। এর ফলে কাঁচাবাজারগুলো এখন চরম করোনা ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে লকডাউনের পর রাজধানীর বড় বগ সড়কের পাশে মার্কেটগুলো বন্ধ থাকলেও অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লার সব দোকানপাটই খোলা। এছাড়া রেস্টুরেন্টগুলোতে শুধু খাবার বিক্রি করা যাবে বসে খাওয়া যাবে না- এমন নির্দেশনা দেয়া হলেও কোন কোন রেস্টুরেন্টে বসে বসেই খেতে দেখা যাচ্ছে। আর নগরবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যাপারে তেমন তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দেশে যে করোনা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় অতি সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির একটি করোনা টেস্ট কেন্দ্রের রিপোর্ট থেকে। সেখানে একদিনে ৫৭ জন পেশাদার সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্য করোনা পরীক্ষা করাতে দেয়। এর মধ্যে ২৮ জনের দেহে করোনাভাইরাস রয়েছে বলে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এই যদি হয় করোনা পরিস্থিতি তাহলে দেশের অবস্থা কি ভয়াবহ। তারপরও সাধারণ মানুষ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। এর ফলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে না মানুষ। তাই অধিকাংশ করোনা রোগীই বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছে। রাজধানীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ অধিকাংশ হাসপাতালেই এখন করোনার নতুন রোগী ভর্তি করানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এর ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতালেও করোনা রোগীর জন্য চিকিৎসা সীমিত থাকায় মানুষ সেবা পেতে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক নাজমুল মোঃ ইসলাম মুন্না জানান, বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের যে অবস্থা তাতে সর্বস্তরের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সবাইকে তার নিজের স্বার্থেই সরকারের দেয়া নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
×