ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্যান অংশের নতুন বিন্যাস, সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

উদ্যান অংশের নতুন বিন্যাস, সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ পরিকল্পনা

মোরসালিন মিজান ॥ ফেব্রুয়ারি মাস যাচ্ছে, যাচ্ছে বটে, বইমেলাহীন। ভাষার মাসে বই ঘিরে কী বিশাল আয়োজন থাকে! এতকাল ধরে চলা আয়োজনে এবারই প্রথম ছেদ পড়ল। ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণের জনস্রোত এসে আছড়ে পড়ল না বাংলা একাডেমির মেলায়। বসন্ত উৎসবে রং এসে লাগল না। এই প্রথম। তবে সামনে আছে বিরাট এক উপলক্ষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ভাষা আন্দোলনের রক্তবীজ থেকেই তো স্বাধীনতা। সে যোগসূত্র আর অভিন্ন চেতনার জায়গা থেকে এবার মার্চে আয়োজন করা হচ্ছে একুশের বইমেলা। হ্যাঁ, করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই এ পরিবর্তন। এখনও অতিমারী দূর হয়নি। তবে জনমনে শঙ্কা কিছুটা কমেছে। তাছাড়া একুশের ইতিহাস আঁকড়ে ধরে থাকা বইমেলা ঘিরে বাঙালী পাঠকের বিপুল আবেগ। আবেগটুকুর মূল্য দেবে না- সাধ্য কার? সব দিক বিবেচনায় আগামী ১৮ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি। ফেব্রুয়ারিতে মেলা করা না গেলেও, এ মাসেই চলছে মূল প্রস্তুতি। এরই মাঝে প্রস্তুতি কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে। এবারও মেলার প্রধান ভেন্যু সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। বিশাল উদ্যানের অধিকাংশ জায়গা স্টল ও প্যাভিলিয়নের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ অংশেই হবে বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। বুধবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে এবারের মেলা সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া গেল। বাঁশের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে যাওয়ায় মেলার চেহারা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতা স্তম্ভের গ্লাস টাওয়ারটিকে কেন্দ্র করে উদ্যানের বিন্যাস করা হচ্ছে। আগেও এ চেষ্টা দেখা গেছে। তবে এবারের চেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হবে এটি। কারণ গ্লাস টাওয়ারের ওয়াটার বডির তিন পাশেই বসছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল ও প্যাভিলিয়ন। প্রথমবারের মতো নেয়া হলো এ উদ্যোগ। এর ফলে স্বাধীনতা স্তম্ভ বেশ জোরালোভাবে মেলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে গেলেও, এখন পর্যন্ত মেলার প্রাথমিক নক্সা প্রকাশ করা হয়নি। তবে খোঁজ-খবর করে নক্সার একটি স্ক্রিনশট পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী, এবার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ভেন্যুটি হবে ডিম্বাকৃতির। উদ্যানের সীমানা ঘেঁষে কংক্রিটের ওয়াকওয়ে। ওয়াকওয়েটিকে মেলার সীমানা রেখা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সার্কেলের ভেতরেই হবে মেলা। নান্দনিক বিন্যাস ও ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় নতুন সীমানা নির্ধারণ ভাল বৈ মন্দ কিছু হওয়ার কথা নয়। তবে একেবারেই নতুন তথ্য হচ্ছে, এবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রান্ত দিয়েও মেলায় প্রবেশ করা যাবে। একই প্রান্ত দিয়ে থাকবে বের হওয়ার ব্যবস্থাও। এই পরিকল্পনা, নিশ্চিত করেই বলা যায়, দর্শনার্থীদের আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। পাশাপাশি টিএসসি ও বাংলা একাডেমি প্রান্ত দিয়ে আগের মতোই যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। তিন দিক থেকে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করোনা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। আরও একটি নতুন সংযোজন আশ্রয় কেন্দ্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা ভেবে মেলায় দুটি আশ্রয়কেন্দ্র রাখা হচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টি ঝড় বা এ ধরনের কিছু দেখা দিলে পাঠক এগুলোতে আশ্রয় নিতে পারবেন। গত দুবছর ধরে মেলার নক্সা প্রণয়ন বিন্যাস ও সাজ সজ্জার কাজটি করছেন স্বনামধন্য স্থপতি শিল্পী ও পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর। ভালাসা থেকেই কাজটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। এবারও দায়িত্ব তার কাঁধে। তবে এখনই নক্সা ও পরিকল্পনা বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে নারাজ তিনি। প্রশ্ন করা হলে কিছুটা রাখঢাক করেই জাবাব দেন। প্রথমেই শিল্পী-মনের অতৃপ্তির কথা। মেলা পরিচালনা কমিটির এ সদস্য বলেন, একুশের মেলা। মার্চে গড়াল। ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে কানেকশনটা তাই খুব মিস করছি। তবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কথা মাথায় রয়েছে। ওটা ধরেই জাতীয় চৈতন্যের জায়গাটাতে নাড়া দিতে চাই। কোভিড পরিস্থিতির কথাও বিবেচনায় রয়েছে তার। সে কথা জানিয়ে বলেন, বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মেলায় আগতদের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোন কম্প্রমাইজ করা হবে না। গরমের সময় হলেও, একটা ফুরফুরে অনুভূতি তাদের হবে। আরাম হবে। বিকেলটা সুন্দর উপভোগ করতে পারবেন। একেবারেই নতুন একটি উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মেলাটি যেহেতু বইয়ের; পাঠাভ্যাস বাড়ানোর ব্যাপারে কিছু করা উচিত। সে চিন্তা থেকে একটি প্রস্তাব একাডেমিকে আমি দিয়েছি। বই থেকে কেউ হয়তো পাঠ করল। অন্যরা তা শুনল। বাস্তবে এবং ভার্চুয়ালিও এটি হতে পারে। নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। আর কিছু? নান্দনিক চিন্তা থেকে মেলায় কী কী যোগ হচ্ছে? এ প্রশ্নে একদমই মুখ খুলতে রাজি হননি তিনি। বলেন, আছে তো অবশ্যই। অনেক পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছি। গত বছরে জুন থেকে চিন্তা করছি তো এটা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী হবে তা আরও কয়েকদিন পরে বলা যাবে। তার মানে, কিছুটা রহস্য থেকে যাচ্ছে। রহস্য? নাকি সংশয়? কেন? মেলার প্রস্তুতি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলা একাডেমি অংশেও। এখানে সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের স্টল বরাদ্দ দেয়া হবে। তার চেয়ে বড় কথা, এ অংশেই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চ। বর্ধমান হাউস সংলগ্ন খোলা জায়গায় বাঁশের কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবছর একাডেমি মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী মেলার উদ্বোধন করেন। এবার কোভিডের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাইরের কোন কর্মসূচীতে যোগ দিচ্ছেন না। একই কারণে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার সশরীরে উপস্থিত না থাকার কথা নয়। এখন পর্যন্ত তথ্য, ভার্চুয়ালি মেলা উদ্বোধন করবেন তিনি। এর পরও মঞ্চটি অন্যবারের মতোই গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে চলেছে কাজ। মেলা উপলক্ষে বাড়তি ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আয়োজক বাংলা একাডেমি। বহুবিধ প্রস্তুতি সেরে রাখতে হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এরই মাঝে পাওয়া গেছে দুঃসংবাদও। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী। তবে অবস্থা উন্নতির দিকে। দ্রুতই তিনি কাজে ফিরতে পারবেন বলে জানা গেছে। তো, এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে? জানতে চাইলে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভাল। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। প্রতিদিন শতাধিক শ্রমিক অবকাঠামো তৈরির কাজ করছেন। আমাদের প্রায় সাড়ে তিন শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী আয়োজনের সঙ্গে কোন না কোনভাবে যুক্ত রয়েছেন। কাজ তাই যথারীতি এগিয়ে চলেছে। তিনি জানান, এবারের মেলায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ উপস্থাপনা থাকবে। ধারণা করা হচ্ছিল করোনাকালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ কমবে। কতটা কমছে? এমন প্রশ্নে উল্টো তথ্য দেন তিনি। জানান, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমছে না। মোটামুটি গত বছরের মতোই। এবারও সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৫শ’ প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নেবে। প্যাভিলিয়ন থাকছে ৩৪টি। শিশুদের জন্য আলাদা চত্বর, লিটলম্যাগ ইত্যাদিও রাখা হবে। তিনি বলেন, মেলায় তিনটি প্রবেশ পথ থাকায় এবার কোন অংশকেই প্রান্তিক মনে হবে না। সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই পাঠক পাবেন। সেভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা ভেবে অন্যান্যবারের চেয়ে স্টলের কাঠামো অনেক মজবুত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। কিন্তু মেট্রোরেলের কী হবে? এখনও টিএসসি থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত সড়ক বন্ধ রয়েছে। কাজ চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের। সমাধান কী? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মেলা শুরুর আগে এলাকাটি খুলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। অর্থাৎ, চ্যালেঞ্জ অনেক। সম্ভাবনাও কম নয়। অমর একুশে বইমেলা ২০২১ নিয়ে তাই আশাবাদী হওয়াই যায়।
×