ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দিনরাত ছুটে চলেছে মুমূর্ষুদের সেবায়

ওরা অক্সিজেনের ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত: ২২:৫২, ২০ জানুয়ারি ২০২১

ওরা অক্সিজেনের ফেরিওয়ালা

ওয়াজেদ হীরা ॥ গত মার্চ মাসে দেশে শুরু হয় করোনার সংক্রমণ। এরপর জুন, জুলাইয়ে প্রকট আকার ধারণ করলে বাজার থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার উধাও হয়ে যায়। নির্ধারিত মূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশি দামেও পাওয়া যাচ্ছিল না অক্সিজেন সেবা। প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটত রোগী ও স্বজনদের। ঠিক সে সময়ই করোনাসহ মুমূর্ষু রোগীদের সেবায় বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা নিয়ে আসেন ছাত্রলীগের তিন নেতা। সেবাটির নাম দেন ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’। সেই থেকে শুরু প্রতিটি দিন রাত সমান তালে ফোন ফেলেই ছুটে যাচ্ছেন মানুষের সেবায়, ওরা অক্সিজেনের ফেরিওয়ালা। ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’ স্লোগানে শুরু হওয়া কার্যক্রম এখনও চলছে সমান তালে। প্রায় চার হাজার মানুষের সেবা দেয়া উদ্যোক্তারা স্বপ্ন দেখছেন একদিন নতুন একটি ভোর আসবে যেদিন করোনামুক্ত হবে বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্ব। সেবাটি ২৫ জুন থেকে ঢাকায় চালু হলেও পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর এবং ফেনী, বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার জেলা শহরে এ সেবা চালু হয়েছে। এসব জায়গায় অক্সিজেনের জন্য ফোন করলে স্বেচ্ছাসেবকরা বাসায় অক্সিজেন পৌঁছে দেন। এছাড়া কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার পাঠিয়ে থাকেন তারা। ৬টি সিলিন্ডার দিয়ে শুরু করলেও এখন ৭৬টি সিলিন্ডার দিয়ে কাজ চলছে। বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দেয়ার প্রথম উদ্যোগ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তার সঙ্গে এগিয়ে আসেন ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ডাকসুর সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ। তাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করছেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ২০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক। বিগত ৬ মাসে তাদের থেকে সেবা নিয়েছেন তিন হাজারের বেশি মানুষ। শুরুতে শুধু করোনা রোগীর জন্য সেবা চালু থাকলেও বর্তমানে যে কোন রোগী চিকিৎসকের পরামর্শপত্র দেখিয়ে এই সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। জানা গেছে, করোনার পিক আওয়ারের সময় সাধারণ মানুষের কথা ভেবে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়। কেননা, করোনা আক্রান্ত রোগীর অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা অন্যতম। কিন্তু দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুদ কম। এরই মধ্যে সুযোগ বুঝে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে অক্সিজেনের দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছেন। মানবিক কাজে মানুষদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ সাদ’-এর পরিবারের সবাই হয়েছিলেন করোনা আক্রান্ত। কিন্তু থেমে থাকেননি তারা। মানবিক কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন এখন পর্যন্ত। রাজধানীর পলাশী বাজারের ব্যবসায়ী মাহবুব এই সেবা পেয়ে এটতাই কৃতজ্ঞ বলতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসে বারবার। মাহবুব মনে করেন করোনার ওই সময়ে শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়াতে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। মিরপুরের বাসিন্দা হাসান আজাদ সেবার বিষয়ে বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সন্ধ্যার পর থেকে বাবার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় অনেক স্থানে খোঁজ নিয়েও কোন সুরাহা করতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল শুধু অক্সিজেনের অভাবেই বুঝি বাবাকে হারাতে যাচ্ছি। এসময় বাবাকে দেখতে আসা কিছু ছোটভাই এই সেবার সন্ধান দেন একই সঙ্গে ফোন করে দেন। ঘণ্টা খানেকের কম সময়ে আমি তাদের উপস্থিতি দেখে নিজেই চমকে উঠেছি যে এটা কি সত্যি! ভাষায় বোঝানো যাবে না আমরা কত উপকৃত হয়েছিলাম। উদ্যোক্তারা জানান, ২৫ জুন রাজধানীতে শুরু হওয়া কার্যক্রমটি পরের মাসেই ২৫ ও ২৯ জুলাই আরও দু’টি বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে ছড়িয়ে দেন। আরও একমাস পর ৩ আগস্ট ফেনী জেলার মাধ্যমে শুরু হয় জেলাভিত্তিক কার্যক্রম। এছাড়াও ৬ আগস্ট থেকে শুরু করে কুরিয়ারের মাধ্যমে সারাদেশে আক্রান্ত রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ কার্যক্রম। এরপর ৮ নবেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলায় ও ২৬ নবেম্বর শুরু হয় বগুড়া জেলায় অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম। বর্তমানে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ এবং খুলনায় কার্যক্রম চালু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই মানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন। তারা ৭৬টি সিলিন্ডারের মাধ্যমে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাদ বিন কাদের চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এমন একটা মহামারী যা নিয়ে আমার কখনও ধারণা ছিল না। তবে রোগের উপসর্গ বোঝার পর থেকে বাজারে প্রত্যেকটা পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকে। শুরুতে স্বেচ্ছাসেবক পেতে কষ্ট হলেও বর্তমানে সারাদেশে আমাদের ১২০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। সেবা গ্রহীতারাও খুশি ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস’-এর সেবা পেয়ে। আমাদের দায়িত্ববোধ দেশের প্রতি ভালবাসা, মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকে কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তারই ফল হিসেবে এখন দায়িত্বটাকে বিভাগ থেকে জেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক আক্তারুজ্জামান সিনবাদ বলেছেন, গত নবেম্বরে আমার চিকিৎসক ভায়রা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এ সময় তিনি বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। একদিন রাতে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ায় তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমরা কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এক পর্যায়ে রাত দেড়টার দিকে জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের সাদ’কে ফোন দিই। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন তাদের কাছে রিফিল করা কোন সিলিন্ডার ছিল না। কিন্তু তারা আমাকে হতাশ হতে দেয়নি। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিরপুরে গিয়ে সিলিন্ডার রিফিল করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমার ভায়রার বাসায় পৌঁছে দেয়। তিনি আরও বলেন, পরের দিন ভায়রার ভাইয়েরও (করোনা রোগী) অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন পড়ে। সেদিনও তারা আরেকটি সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়। এই শিক্ষক বলেন, এই দুর্যোগে আমরা অনেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখি। কিন্তু তারা যে কাজটি করছে সেটি অনেক বড়। মানবসেবায় তাদের এগিয়ে আসা নিঃসন্দেহে ভাললাগার। তারা অনেক রোগীর কষ্ট কমিয়ে দেয়ার মাধ্যম হয়েছে। আমি চাই এমনভাবে সকলের নিজ নিজ জায়গা থেকে ভাল কাজে এগিয়ে আসুক। গত ৩ নবেম্বর রাত পৌনে ৪টার দিকে আবিদ হাসান অমি নামে এক সেবা গ্রহীতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিগত ২ মাস ধরে আমার আম্মা ফুসফুসে রোগাক্রান্ত হয়ে ভুগছেন। হঠাৎ আজ রাত ২টায় আম্মার অক্সিজেন লেভেল ৬৭-এ চলে আসে। এমন অবস্থায় কোথাও অক্সিজেন সিলিন্ডার পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই আমার পাশে এসে দাঁড়ায় সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তিনি বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সাহায্য করেছেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি সিলিন্ডার পেয়ে যাই আমার আম্মার জন্য। আমি এই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুক।’ সেবা পাওয়া সায়েদ জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন যে কোন সময় কমে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালেও তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন সেবা মেলে না। কিন্তু ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’র মাধ্যমে দিন বা রাতের যে কোন সময় এই সেবাটির নিশ্চয়তা রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এই কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে। আমরা প্রতিমাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্থিক বিবরণীর সম্পূর্ণ হিসাব দিয়ে থাকি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সাদ বলেন, আমাদের জন্য কাজটি সহজ ছিল না। আমরা যখন শুরু করি তখনকার পরিস্থিতি বর্তমানের মতো ছিল না। মানুষের মাঝে বিরাজ করছিল করোনার মারাত্মক ভীতি। কোন বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গেলে আশপাশের মানুষের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। এমনও হয়েছে অক্সিজেন নিয়ে গেলে ছেলে সামনে আসেনি। তার বাবাকে আমরাই অক্সিজেন সেট করে দিয়ে এসেছি। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিকতায় এই কাজটি পরিচালনায় অনেক সহজ হয়েছে। জীবন এবং পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে তারা এই মানবিক কাজে আমাদের সঙ্গী হয়েছেন। তিনি বলেন, আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারের দোয়া ও ভালবাসা আমাদের কাজ করতে অনুপ্রাণিত করছে। আসলে মানুষের জন্য কাজ করার সময় ও সুযোগ সবসময় আসে না। যতদিন এই পরিস্থিতি চলবে ততদিন আমরা এই কার্যক্রম চলমান রাখব। এই কাজে এগিয়ে আসে বিভিন্ন প্রবাসী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন স্তরে অবদান রাখা মানুষদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন সাদ বিন কাদের বলেন, দেশের জন্য যে কোন উদ্যোগ নিলে এখন ভাল মানুষরা পাশে এসে দাঁড়ায় এটি তারই একটি উদাহরণ। আমরা চাই সেবাটি প্রত্যেক জেলা শহরে নিয়ে যেতে এবং এই মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত মানুষের সেবা করতে চাই। জানা গেছে, শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন ৭/৮টি সিলিন্ডার যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকাতেও অক্সিজেনের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিবিশেষ অসুবিধা বোধ করার আগেই শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে পারে তাই অক্সিজেনের জোর প্রস্তুতি থাকা দরকার। মানব সেবায় কাজ করা এই ফেরিওয়ালারা মানুষের সমর্থন ভালবাসা পাচ্ছেন তেমনি দেশের এই ক্রান্তিকালে দেশ সেবা করতে পেরে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন তারা।
×