ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফেরার গল্প

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৫ জানুয়ারি ২০২১

অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফেরার গল্প

আজাদ সুলায়মান ॥ চার বছরের শিশুকে কোলে নিয়েই মঞ্চে হাজির হন সুদর্শন তরুণ শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত। সামনে দাঁড়ানো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ ও র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ অন্য কর্মকর্তারা। হল ভর্তি গণমাধ্যম কর্মী ও দেশের শীর্ষ মনস্তত্ত্ববিদরা। সবার সামনেই মা-বাবার কোলে তুলে দিলেন নিজের শিশুকে। নাতিকে পাওয়ার আনন্দে অশ্রুসিক্ত দাদা-দাদি। এতদিন পর দেখা পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতিন। অন্ধকার জীবন ছেড়ে আলোর ভুবনে ফেরার এমন দৃশ্য সচরাচর মেলে না এমন আড়ম্বর অনুষ্ঠানে। এমন দৃশ্যে উপস্থিত সবার চোখেও জল গড়ানোর উপক্রম। তাদের সামনেই শাওন জানালেন তার জঙ্গী হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী। আরও রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে তার ফিরে আসার গল্প। কেননা অপরাধ বিশেষজ্ঞের মতে, অন্ধকার জীবনে যাওয়া যেমন চ্যালেঞ্জিং- তেমনই ফিরে আসাটাও তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। শাওনের মতো এমন নয়জন জঙ্গী জীবনের পঙ্কিল পথ ছেড়ে আলোকিত সমাজে ফিরে আসার আগে পরে ঘটনা, আত্মসমর্পণ ও পলাতক জীবনের অন্ধকার দিক তুলে ধরেন। র‌্যাব তাদের এই কর্মসূচীকে বলছে, ‘ডি-র‌্যাডিকালাইজেশন এ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’। র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, পেশার ধরন অনুযায়ী এই তরুণ-তরুণীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে। সিলেটের এই তরুণ শাওন জানালেন, পড়তে পড়তেই শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত জড়িয়ে পড়েছিলেন উগ্রবাদী এক সংগঠনে। পরে ডাক্তার স্ত্রী নুসরাত আলী জুহিকেও সেই জালে জড়িয়ে নেন। সংগঠনের নির্দেশে চার বছর আগে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পরিবার থেকেও আলাদা হয়ে যান। কিন্তু সে সবই যে ভুল ছিল, এখন তা বুঝতে পারছেন তারা। উগ্রবাদের অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়া এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার গল্প তুলে ধরে শাওন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ‘ধর্মীয় ব্যাখ্যায় আকৃষ্ট হয়ে ২০০৯ সালে তিনি হিযবুত তাহরির সঙ্গে যুক্ত হন। কয়েকজন বন্ধুকেও ওই সংগঠনে যুক্ত হতে উৎসাহ দেন। ২০১১ সালে মেডিক্যাল ছাত্রী জুহির সঙ্গে বিয়ে হয় শাওনের। স্বামীর উৎসাহে জুহিও এক সময় ওই সংগঠনে যোগ দেন। শাওন বলেন, এখন পর্যন্ত কোন ধরনের নাশকতার কাজে তারা জড়াননি। ২০১৬ সালের পর থেকে সংগঠন থেকে তাদের বলা হয়, পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তারা ঢাকার এসে থাকতে শুরু করেন। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক, কিন্তু এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে তার জীবনে অশান্তি আর গ্লানি নেমে আসে। এক কথায় আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। তাছাড়া আমার দুই শিশু সন্তানের ভবিষ্যত। শাওন বলেন, একটা সময় আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আমি ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার। আমার ভেতরে নতুন করে বোধোদয় হয়। তখন পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করি, নতুন করে বেঁচে থাকার কথা বলি। তারপর এখানে আসা।’ উল্লেখ্য, শাওন-জুহির পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব সদর দফতরে এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। চার বছর পর ছেলে আর ছেলের বউকে কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন শাওনের বাবা শওকতুর রহমান। নিজে একজন ব্যাংকার ছিলেন জানিয়ে শওকত বলেন, তার ছেলে কিভাবে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে গেল, তিনি তা বুঝতেও পারেননি। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, কারও সন্তান যাতে এভাবে জঙ্গীবাদে না জড়ায়, সবাইকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ সময় শওকত রহমান বলেন, অনেক দিন ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনিনি। অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। শুনেছি শাওন বিয়ে করেছেন, তার সন্তান হয়েছে। ছেলের বউ বা নাতিকে কখনও দেখিনি। অপেক্ষায় ছিলাম কখন তাদের দেখতে পাব। আজ সে অপেক্ষা কাটল। ওদের ফিরে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। তিনি বলেন, আমার একটি মেয়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেছে এবং আমার আরেক ছেলে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল থেকে ডাক্তারি শেষ করে বের হয়েছে। সামাজিকভাবে আমার একটা অবস্থান আছে। আমার সব ছেলে-মেয়ে মেধাবী। কিন্তু হঠাৎ করে আমার ছেলে শাওন পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। এটা আমি কখনও বুঝতে পারিনি। অথচ তার পূর্বের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনভাবে সামঞ্জস্য নয়। শাওনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছিল। শাওন অনেকদিন ঘর ছাড়া ছিল আমি আমার ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পাইনি। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার ছেলে এবং আমার বউমার কোলে বাচ্চা আসবে। এর মধ্যে তাদের ফিরে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। তিনি বলেন, সন্তান বিপথে চলে গেলে বাবা-মা কি কষ্টে থাকে এটা বোঝানো কঠিন। এই অন্ধকার পথ থেকে ছেলে-মেয়েদের বাঁচাতে হলে সবার আগে তার বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা যাতে জঙ্গীবাদের মতো বিপদে না যায় সেজন্য সব থেকে বেশি বাবা-মাকে সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে। আমি সব বাবা-মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সবাই সন্তানদের প্রতি আরও যত্নবান হোন, আপনার সন্তানের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি সবাইকে বলতে চাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমরা সবাই যদি সচেতন হই, তাহলে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা সম্ভব হবে এবং অচিরেই বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। শাওনের চেয়ে আরও শিহরণ কাহিনী শোনান আবিদা জান্নাত ওরফে রাইসা। অষ্টাদশী এই তরুণী জানান, ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করে। তখন ফেসবুকে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়, এরপর গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেন ওই যুবককে। এরপর বিদেশে পড়তে যান। এরই মধ্যে স্বামীর উৎসাহে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বলেন, প্রেমের সূত্র ধরে ২০১৮ সালে পরিবারের অনুমতি ছাড়াই তাকে বিয়ে করি। পরবর্তীতে পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে যাই। সে সময় স্বামীও আমার সঙ্গে দেশের বাইরে যায়। মূলত এটা তারই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়। কিন্তু আমার পরিবার জানত না। ছয় মাসের মতো আমরা দেশের বাইরে ছিলাম। এরপর আবার দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে এলেও আমার পরিবার জানত না। দেশে ফিরে আমি আর আমার স্বামী প্রায় দেড় বছর বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকি। ওই সময়ই আমি আমার স্বামীর বিষয়ে জানতে পারি যে সে একটি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। আমি জানার পর আমার স্বামী আমাকেও তার সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা বলে। জঙ্গীবাদে তার কাজে সাহায্য করতে বলে। স্বামীর কথা শুনে আমিও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে যাই। আসমা বলেন, আমি যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম সেটা আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। একটা স্বাভাবিক জীবন না। বাবা-মায়ের আদর-ভালবাসা-স্নেহ থেকে দূরে সরে এসে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতাম। ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যে মানুষটি আমাকে জীবনসঙ্গী করে নিয়েছিল, সে মানুষটিও অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে থাকে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। নিজেকে খুব অসহায় লাগতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আমি ওই পথ থেকে ফিরে আসতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিই। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আজ আত্মসমর্পণ করি। এটি সম্ভব হয়েছে র‌্যাবের সহযোগিতার কারণে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাবের প্রতি। বক্তব্যের শেষে দেশের তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি অবশেষে বুঝতে পেরেছি, আমি ভুল পথে ছিলাম। আমি চাই না আমার মতো আর কেউ ভুল করুক। এ পথে পা না বাড়িয়ে সবাই যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করি। আমি আমার পলাতক স্বামীকেও ভুল পথ থেকে ফিরে আসার আহ্বান করছি। সবারই উচিত নিজের আত্মিক ও মানসিক পরিচর্যা করা। নিজের প্রতি নিজের জাজমেন্ট থাকা। কোন কিছু অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আসমার মা শাহিদা সুলতানা বলেন, কি যেন হারিয়েছিলাম। আজ আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমরা আসমাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালবাসতাম। কিছুদিন আগে জানতে পারি, আসমা যাকে পালিয়ে বিয়ে করেছে সে একজন জঙ্গী। সে তাকেও জঙ্গী বানিয়েছিল। একজন জঙ্গীর মা হওয়া অনেক কষ্টের। আমি সব মা-বাবাকে অনুরোধ করব, আপনাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াাল রাখুন, সময় দিন। এক পর্যায়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে শাহিনা সুলতানা বলেন, আমার মেয়ে মেধাবী ছিল। ভাবতাম, সে অনেক কিছু করবে সমাজের, অনেক বড় অফিসার হবে। কিন্তু কিভাবে যে কি...। এখন আমার মেয়ের জন্য আপনারা দোয়া করবেন। ২০১৯ সালে এসএসসি পাস করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক তরুণের সঙ্গে পরিচয়ের পর বিয়ে করে ফেলেন এই কিশোরী। সেই তরুণের মাধ্যমেই জড়িয়ে পড়েন জঙ্গীবাদে। এরপর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবনের যে কষ্ট, সে কথা তুলে ধরে আসমা বলেন, আমি ভুল করে এ পথে এসেছিলাম। ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেছি। আশা করছি আমার স্বামীও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। একজন জঙ্গী হওয়ার আগে কোন একটি সংগঠনের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়, পরে সমর্থক হয়ে ওঠে। তারপর যে সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশ নেয়, তার ভেতরে উগ্রবাদের ধারণা পোক্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা অস্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করে। এ অবস্থায় তাদের মস্তিষ্কে যে ধারণা বা মতবাদ বসে আছে, সেটা অস্ত্র দিয়ে নির্মূল করা যায় না। সেখান থেকে তাদের বুঝিয়ে বের করে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেজন্য র‌্যাব ডি-র‌্যাডিকালাইজেশন না এই পুনর্বাসন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। প্রসঙ্গত, আত্মসমর্পণ করা এই তরুণ-তরুণীদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ আইটি বিশেষজ্ঞ, কেউ ছাত্র। কিন্তু তারা জেএমবি বা আনসার আল ইসলামের মতো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে পুরনো একটি মামলা রয়েছে, বাকিদের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের মধ্যে মামুনকে ফার্মেসি, সাইফুল্লাহ ও সোহেলকে গাভী, সাইদুর, হাসান ও সাইফুলকে ট্রাক্টর দিয়ে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
×