ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৬ বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জট খুলছে না

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

১৬ বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জট খুলছে না

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জট খুলছেনা ১৬ বছরেও। পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও এত সহসা ফিরে যাওয়ার পক্ষে মতামত না দেয়ায় ঝুলে রয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে দুই দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসন করতে আগ্রহী। তবে মিয়ানমারের অসহযোগিতা এবং রোহিঙ্গারা সহজে ফিরে যেতে চাইছেনা বলে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম তরান্বিত করা যাচ্ছেনা বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সব প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় নতুন করে প্রত্যাবাসনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়নি। সর্বশেষ গত ২০১৯ সালের ১৫ নবেম্বর ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার দ্বিতীয় পদক্ষেপ। গাড়ি, ত্রাণ-শুকনো খাবারসহ সব ধরনের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফিরে যেতে আগ্রহীদের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার জন্য গাড়িও পাঠানো হয়েছিল নির্দিষ্ট ক্যাম্পে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ‘হ্যাঁ’ শব্দ না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি। অপরদিকে মিয়ানমার কথা দিয়েও কথা না রাখার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছেনা। মিয়ানমার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে উভয় দেশের কর্মকর্তা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সভা-মিটিংয়ে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার বিষয়ে একমত পোষণ করে সফর বা মিটিং শেষে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পর ওই সিদ্ধান্তের কথা ভুলে যান তারা। মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হচ্ছেনা বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, রোহিঙ্গাদের বুঝাতে ২০১৯ সালে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রীসহ দুই দফায় দেশটির উচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধি দল সফরে আসেন উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে। তারা ওই সময় বৈঠক করেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি শুনে দেশে ফিরে গিয়ে সরকারের কাছে উপস্থাপন করার আশ্বাস দেয় দেশটির প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গারা এ সময় মিয়ানমারে বসবাসের বিভিন্ন কার্ড, জমির দলিল ও সরকারের দেয়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখালে মিয়ানমারের মন্ত্রী সবই মেনে নিয়ে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়েও তখন আশ্বাস দেন। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পর ৬ মাস বসবাস শেষে যারা নাগরিকত্বের আবেদন করবে, তাদের বিষয়ে সরকার তা বিবেচনা করে দেখবে বলে জানান দেশটির সমাজকল্যাণমন্ত্রী। এরপর দাবি পূরণ না হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেনা বিষয়টি জানান দিতে উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জমায়েত করে তারা যে একতাবদ্ধ তা প্রমাণের চেষ্টা চালায়। তবে ওই মহাসমাবেশের আয়োজনের জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতি না নেয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য এটি বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে মিয়ানমার সরকারও প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে এগিয়ে আসেনি। মিয়ানমারের ছলচাতুরী ও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ও ২০১৯ সালের ১৫ নবেম্বর বাংলাদেশ সরকার দুই দফা উদ্যোগ নিলেও প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের একগুয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে ২০০৫ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। স্থানীয়রা বলেন, মিয়ানমার কথা দিলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবেনা। এছাড়াও বিদেশী কিছু এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কর্মকাণ্ডে গোপনে বিরোধিতা করে চলেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান করে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাপ প্রয়োগ করলে মিয়ানমার সরকার ওই সময় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। দেশটির নেত্রী আউং সান সুচির গঠিত কমিটি ‘কোফি আনান কমিটি’ দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রস্তাব আনেন। এ সময় কোফি আনান কমিশনের ওই প্রস্তাবে বিভিন্ন স্থানে ঘাঁপটি মেরে থাকা রোহিঙ্গা জঙ্গীরা এক প্রকারে নাখোশ হয়ে পড়ে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের কোনই লাভ হবেনা। বাংলাদেশে পালিয়ে আসলে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা (জঙ্গী) বিদেশীদের কাছে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশী অর্থ (সাহায্য) এনে লুটেপুটে খেতে পারবে। তাই সশস্ত্র রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে হামলে পড়ে দেশটির সরকারী বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে। ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা বর্বর অত্যাচার শুরু করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর। দুইদিন পর ২৭ আগস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় পার হয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিয়তা কাটেনি। কখন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে, তা কেউ বলতে পারছেনা। সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সরকারের কাছে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার তালিকা পাঠানো হয়েছে। দেশটির বাসিন্দা কিনা যাচাই বাছাই করে মিয়ানমার সরকার ওইসব তালিকা থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গার ছাড়পত্র দিয়েছে। ওই ৩০ হাজার থেকে এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকে ফের নেয়নি মিয়ানমার। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এইসব রোহিঙ্গা ছাড়াও ২০১৬ সালে আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭৮, ১৯৯২, ১৯৯৪, ২০১২ সালেও বাংলাদেশে আসা আরও প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা দশকের পর দশক ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছে। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা দেশটির ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলদেশ বহন করে চলেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে এই সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন কর্মকাণ্ড শেষ হওয়া উচিত ছিল। সব পক্ষের জন্য মঙ্গলজনক এমন একটি ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশের সৎ উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমার কখনও তাদের জনগণকে সহসা ফিরিয়ে নেয়নি। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বলেন, আমরা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব চাই। এখানে (বাংলাদেশ) যেমন অবাধে যাতায়াত করছি, সেখানেও তেমনটি চাই। আমরা এখানে যেমন পড়াশোনা করছি, সেখানেও শিক্ষার সুযোগ চাই। আমাদের স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা প্রয়োজন। আমরা সর্বদা ফিরে যেতে প্রস্তুত, তবে কেবল যদি আমাদের জাতীয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রত্যাবাসনে বিলম্ব হচ্ছে দেখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়া বেশির ভাগ রোহিঙ্গা বর্তমানে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে। অনেকে রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগে আসা রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন এবং বিদেশীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে বিপুল টাকার মালিক বনে গেছে। ফলে এসব রোহিঙ্গা নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে জানা গেছে। তাই আগে আসা রোহিঙ্গা যারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে, তাদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। ১৯৭৮ সালের পর থেকে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য এসে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে। তারা বর্তমানে অনেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে পরিচয় গোপন করে জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছে।
×