ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

খাঁটি গুড় এখন দুর্লভ

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২১ ডিসেম্বর ২০২০

খাঁটি গুড় এখন দুর্লভ

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ ‘খেজুর রস খেজুর গুড়, দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর।’ এই প্রবাদ এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিচ্ছে। উৎপাদনকারীদের অতি লোভের কারণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে জেলার সুস্বাদু খেজুর গুড়। ফলে খাঁটি গুড় পাওয়াটা এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। ওজন বৃদ্ধির জন্য খেজুর রসের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে চিনি এবং রং ফর্সা করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত সালফার। ২০/২৫ বছর আগেও এখানকার খেজুর গুড় ছিল দেশের ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। যুগ যুগ ধরে এ ঐতিহ্যকে লালন করেছেন খেজুর গুড় উৎপাদনকারী হাজার হাজার গাছি ও ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, এ ঐতিহ্যগত মৌসুমি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল এ অঞ্চলের গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা। কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস অর্থাৎ হেমন্ত ও শীত-বসন্তের মাঝামাঝি চার মাস খেজুর গুড়ের মৌসুম। এ মৌসুমে খেজুর গুড়ের ম ম গন্ধে খুঁজে পাওয়া যেত আবহমান বাংলার প্রকৃত রূপ। যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে একশ্রেণীর মানুষের মনে অতি লোভ-লালসার জন্ম হওয়ায় তাদের ভেতরে নকল ও ভেজাল প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ প্রবণতা বেশিদিনের নয়; মাত্র ২৫/৩০ বছরের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করে। যা বর্তমানে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নকল ও ভেজাল প্রবণতা ক্যান্সারের রূপ নিয়ে এক বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছে। যে কারণে ভেজালমুক্ত কোন পণ্য এখন আর আশা করা যায় না। এই ভেজালের কবলে পড়ে এক সময়ের ঐতিহ্য জেলার খেজুর গুড় তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দিন দিন অতি মুনাফাখোর ও অসাধু গুড় উৎপাদনকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠায় গুড়ের হারানো ঐতিহ্য আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। ভেজাল গুড়ে এখন হাট-বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গুড়ের ওজন বৃদ্ধি করতে চিনি আর রং ফর্সা করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত সালফার। যে কারণে সুস্বাদু খেজুর গুড় এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। গত ২৫/৩০ বছর ধরে এ অবস্থা চলে এলেও নেয়া হয়নি কোন আইনী ব্যবস্থা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু গুড় উৎপাদনকারীরা। নানা প্রতিকূলতার কারণে জেলার খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় গুড়ের উৎপাদন ১০-১৫ ভাগে নেমে এসেছে। পৃষ্ঠপোষকতা ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে জেলার ঐতিহ্য খেজুর গুড় ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগের মতো খেজুর গাছে রস হয় না। আগের দিনে এ অঞ্চলের শত শত গাছের রসে হাঁড়ি ভরে যেত; গাছিরা মধ্যরাতে হাঁড়ি পাল্টে দিয়েছে, সকালে গাছ থেকে রসে ভরা হাঁড়ি নামিয়েছে। অর্থাৎ এক গাছে দুই হাঁড়ি রস উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু আজকাল রসের উৎপাদন এতটাই কমে গেছে যে, সন্ধ্যারাতে গাছের আবরণ ছেঁচে হাঁড়ি লাগালে পরদিন সকালে অর্ধেক হাঁড়ি রসও পাওয়া যায় না। এ কারণে গাছিদের শ্রমের মূল্য না ওঠায় অনেকে খেজুর গাছ ‘ঝুরা’ (রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা) বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পেশা বদলে ফেলেছে। এক সময় প্রতিবছর শীত মৌসুমে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গুড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান খুঁজে পেত জেলার ৩৫/৪০ হাজার মানুষ। খেজুর গুড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেই বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া খেজুর গাছ থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি পাওয়া যেত তাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর ৬ মাসের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পারত। এখন আর সে অবস্থা নেই। তাই থেমে গেছে গ্রামীণ জনপদের প্রাণচাঞ্চল্য। ধীরে ধীরে বেকার হয়ে পড়ছেন খেজুর গুড়নির্ভর মৌসুমি শ্রমিকরা।
×