ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

কৃষি ও কৃষককে কর্পোরেটের দাস করবেন না

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

কৃষি ও কৃষককে কর্পোরেটের দাস করবেন না

ভারতে নতুন কৃষি বিল ২০২০ পাস হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে এর অবশ্যম্ভাবী ফল- কৃষকদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনও শুরু হয়ে গেছে। এটা হবার কথাই। কর্পোরেট সংস্কৃতির লোভনীয় নানা ফাঁদ ক্রমশ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মানুষের গলার ফাঁসে পরিণত হবার দৃশ্য তো পৃথিবী জুড়ে দৃশ্যমান। সেদিন আমি একজনকে একটা ফ্রিজ কিনে দিতে গিয়েছিলাম এক দোকানে। নানা দোকান ঘুরে একই জিনিস আগে দেখা শো রুমে একই দামে দেখেও আবার ঘুর পথ এড়াতে একটিতে থিতু হই। নানারকম মূল্য ছাড়ের হিসাব কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে মাত্র দু’শ’ টাকা কমে যখন সেলসম্যনকে সিদ্ধান্ত দিলাম, সেটি দু’শ’ টাকার জন্য নয়, অনেকটা ঘুরে আগের দোকানে যেতে হবে বলে যাইনি। থিতু হয়ে বসার পর ওরা দু’জন মিলে হিসাব করতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পর জানাল- ‘ম্যাডাম, এটার সঙ্গে ‘অফার’ পেতে আপনাকে ৫টা ঘর থেকে যে কোন একটা বেছে নিতে হবে, তখন অফারটা এসে যাবে।’ এসব ব্যবস্থা আগে কোনদিন দেখিনি। কিন্তু এখন তো ডিজিটাল যুগ! কতরকম অজানা হাল্কা, ভারী, ‘ফাঁদ’ এর খেলায় যোগ দিয়ে তবেই হয়তো একটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আমাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে একজন তরুণ উৎসাহ দিতে বলল ‘ভয় নেই, সবগুলোতেই ৩% অফার, যে কোনটা বাছতে পারেন।’ বিস্মিত হলাম- পাঁচটাতেই একই ‘অফার’ লেখা থাকে। তাহলে এসব কি জাতীয় খেলা, বুঝতে পারলাম না, কী এর দরকার। আগের দোকানে সোজাসাপ্টা ৩% ও ৫% বলে দাম জানিয়েছিল! বল্লাম, আচ্ছা, তিন নম্বরটা বাছলাম। উঠল ৩%, এরপর বিশেষ ব্যবস্থায় ৫% এর ব্যবস্থা হলো। দাম দু’শো টাকা কম! একটু পর বিল করতে বললাম কম্পিউটারে। না, সেটা আধা ঘণ্টার বেশি লাগবে, বরং, এখন আপনি ম্যানুয়েল বিল নিয়ে যান, ফ্রিজের সঙ্গে, বিল, ওয়ারেন্টি কার্ড সব যাবে। আচ্ছা, বলতেই হয়। টাকা বের করে গুনতে শুরু করেছি, তরুণ বলল, ‘ম্যাডাম, ফ্রিজের স্ট্যান্ড-এর জন্য দু’শো টাকা যোগ হবে।’ মানে, ঐ প্রথম দোকানের মূল্যের সমান হলো এবার, দু’শো টাকা কম হবে না। আচ্ছা, এ শব্দটি ছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তি না জানা এনালগ বা ব্যাংক বুথ ডাকাতির ভয়ে এটিএম কার্ড না করা ক্যাশ বহনকারী মানুষ আর কিই বা বলতে পারে? এবার আসি ভারতে কৃষি ও কৃষক অসন্তোষ এবং আমাদের খাদ্যমন্ত্রীর আমাদের দেশের চালের আড়তদার-মজুদদারদের প্রতি হুঁশিয়ারি প্রদান প্রসঙ্গে। ভরতের সংবিধানে এতদিন ধরে থাকা ধারা অনুসারে কৃষিক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ, বাজার, বাজারের নিয়মাবলী প্রণয়ন এবং এই ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থার পত্তন করা বা না করা এবং সেসবের নিয়ন্ত্রণ রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে, তাদের প্রস্তাব- প্রতিবাদ না শুনে এই বিপুল প্রভাব তৈরিকারী নতুন আইনটি প্রণয়ন করে। আশ্চর্যজনকভাবে সংসদে প্রতিবাদকারী বিরোধীদলীয় সাংসদদের বহিষ্কার করে বিলটি পাস করা হয়! গণতন্ত্র মার খেলেও বিলটি পাস হয়ে গেল! এই করোনায় যখন প্রায় সব পেশাজীবী গৃহবন্দী, আয়-উপার্জন বন্ধ হওয়া মানুষ পুরো বিশ্বে লাখ লাখ! তবে, এখনই এ কথাটা স্মরণ করে নিতে হবে যে, এই মহামারীর তাণ্ডব থেকে এখনও আলো, খোলা হাওয়া ও উন্মুক্ত একরের পর একর জমিতে কৃষক-কৃষি-মজুর আমাদের অন্য পেশাজীবীর জন্য খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে সবরকম কৃষিপণ্য উৎপাদন করে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে! বিস্ময়কর, তাই নয় কি? কৃষকেরা, কৃষি মজুরেরা করোনা আক্রান্তও নন্- মিরাকল বৈকি। আচ্ছা, এটা কী কোন সেই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সুন্দরী কন্যা সেজে ডাইনী বুড়ির ছদ্মবেশে আমাদের, অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত কৃষিকে কর্পোরেট সাম্রাজের কুক্ষিগত করার আপাত কপট কোন অজগরের গ্রাসের মতো ফাঁদ? প্রধানমন্ত্রী, সত্যি আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। আমাদের কৃষক, যার উৎপাদিত ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি, ফল খাই প্রতিদিন, অথচ যাকে বলা চলে মজুতদারদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি না, তবু মজুতদারের উচ্চ মূল্যে খাদ্য পণ্য তাদের বাঁচার লড়াইয়ে হয়তো কিছুটা সহযোগিতা করি, করতে পারি। এখনও সেই কৃষক ভাই কার কাছে বাঁধা পড়ে যাবে? প্রধানমন্ত্রী, মজুতদারের হাত থেকে সাধারণ নিম্নবিত্তের মানুষকে খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা টিসিবি, রেশন, ১০/- টাকার চাল, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কার্ড, বিধবা ভাতা, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদি অসংখ্য এ্যানালগ পন্থাকে ব্যবহার করে কৃষিকে বাঁচানো যায়। থোক অর্থ-বরাদ্দ করা হয়েছিল বলে করোনা মহামারীতে জনমানুষ খাদ্য সঙ্কটেও যেন বেঁচে থাকতে পারে, আয়হীনতাকে, চাকরিচ্যুত হওয়াকে কিছুটা হলেও পরাস্ত করেছে।এসব উপায় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষকে পরিবার, পরিজন নিয়ে অন্নাভাব থেকে রক্ষা করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে- সরকারের শত্রুকেও তা বলতেই হবে বা স্বীকার করতেই হবে। মজুতদারদের হাত থেকে কৃষক-ক্রেতা- ভোক্তাদের বাঁচাতে আবার অন্য একটি নির্দয় কঠোর ‘মালিক’ শ্রেণীর হাতে কৃষক, কৃষি এবং আমরা ভোক্তারা পড়ে না যাই- সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এই ডিজিটাল যুগেও কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে ও খাদ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় আমরা ‘এ্যানালগ’ অথবা এদেশের চিরায়ত প্রথা- রেশন, টিসিবি, বঙ্গবন্ধুর ন্যায্যমূল্যের দোকান এবং উপরিউক্ত ব্যবস্থাগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এখনও ‘ডিজিটাল’ আমরা এটুকুই হব, যেমন-কৃষক তার পণ্যের ক্রেতার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে মূল্য নির্ধারণ করে তা বিক্রি করবে। কৃষি ও কৃষককে ভর্তুকি দেয় না, এমন কোন উন্নত দেশ আছে বলে জানি না। কৃষিপণ্যের বিক্রিতে, ধান কাটায় আমরা এই করোনাকালে যে সৃজনশীলতা সরকার ও সরকার প্রধান প্রদর্শন করেছে, তা সব দেশের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমরা যারা সীমিত পরিসরে ত্রাণ কাজ চালিয়েছি, সে সময় আমাদেরও তরুণ-তরুণীদের কাছে পরামর্শ ছিল ত্রাণে চাল- তেলের সঙ্গে যেন কৃষকদের কাছ থেকে সবজি-ফল ইত্যাদি কিনে নিয়ে প্যাকেট তৈরি করে বিতরণ করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বন্ধ হলেও মনে রাখতে হবে কৃষি মা তাঁর ধরনীর বিছিয়ে দেয়া মাটির খোলা আঁচলে শত বার, যত বেশি সম্ভব খাদ্যশস্য ও সবজি-শাক-ফল-মূল উৎপাদন করেছে! কৃষক একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। থেমে থাকলে আমরা খাদ্যাভাবে পড়তাম। তা হয়নি। একমাত্র বন্যা, ঝড়, পাহাড়ী ঢল, অতি বৃষ্টি কোন কোন এলাকায় ফসল হানি ঘটিয়েছে। কিন্তু পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক নতুন করে বীজ বুনেছে, একদিনও দেরি করেনি। ভারতের নয়া কৃষি চুক্তির ভয়ঙ্কর দিকটি হচ্ছে- এই প্রথম প্রায় নিরক্ষর, পূঁজির সূক্ষ্ম কার্য-কারণ বুঝতে অক্ষম, কৃষকের সঙ্গে বাণিজ্য সংস্থার ‘চুক্তিচাষ’ হবে, যে চুক্তিতে ফসলের পরিমাণ, গুণগত মান, দাম ইত্যাদি আগেই নির্ধারিত থাকবে! ধরা যাক, বন্যা বা পাহাড়ী ঢলে ফসল হানি হলো, তখন কৃষককে ভারতের রাজ্য সরকারগুলো দায়-দায়িত্ব নিয়ে রক্ষা করত। এখন কৃষি ও কৃষকের ওপরে রাজ্য সরকারের কোন দায় দায়িত্ব থাকবে না। বরং কেন্দ্রীয় সরকার অনেক দূর থেকে দরিদ্র, নিরক্ষর, কর্পোরেট সংস্কৃতির ছদ্মবেশী রূপের আড়ালে ডাইনির মতো তাকে বন্দী করার কৌশল অবলম্বন করতে যাচ্ছে। এই সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ কৃষক, তাঁর কৃষক সমিতির কাছে নয়, কৃষি উৎপাদন-বাজার সমিতির কাছেও নয়, আর্জি জানাতে কৃষককে যেতে হবে ধোপদুরস্ত স্যুট-কোট পরা উচ্চ শিক্ষিত মহকুমা শাসক, জেলা শাসক ইত্যাদি কৃষি-কৃষক থেকে বহু দূরের নাগরিক জীবন যাপনে চিন্তায় অভ্যস্ত ব্যক্তিদের অফিসে নির্ধারিত অফিস টাইমের ভিতরে! রাজ্য প্রশাসনের এখানে কোন ভূমিকা নেই, স্থানীয় পঞ্চায়েতেরও নেই কোন ভূমিকা, দেশের আদালতেও কৃষক বিচার চাইতে পারবে না। ও মাই গড! এই সব অফিসের কর্তাদের সময় মতো পাওয়া আমাদের মতো উচ্চ শিক্ষিতেরও যেখানে গলদঘর্ম হতে হয়েছে, হয়, সেখানে এই নিরক্ষর, অল্পশিক্ষিত কৃষককে অফিসের দারোয়ান, পিয়ন যে কতভাবে ঘোরাতে পারে, সেই কথা ভেবে ভীত বোধ করছি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, মজুতদার, আড়তদারদের আধিপত্যে ক্রেতা-ভোক্তা পণ্যের উচ্চমূল্যের খেসারত দিচ্ছে, আবার পণ্য উৎপাদক কৃষকও অনেক কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ, কৃষক ও ভোক্তার মাঝখানে মজুতদার আড়তদারদের নির্যাতন কিভাবে কমানো যায়? কৃষিপণ্যের ন্যুনতম দাম ঠিক করে দেয়ার রেওয়াজ এখন থাকবে না। খোলা বাজারে কৃষকের যে প্রতিযোগীতামূলক দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ থাকে, এখানে কৃষক বাণিজ্য সংস্থার কাছে এক ধরনের চুক্তির ফলে দাসখতই লিখে দিতে বাধ্য হবে। মানে, ঐ নতুন উচ্চ শিক্ষিতের ডিজিটাল কর্পোরেট সংস্থা নতুন ধরনের দাস-মালিক তৈরি করবে না কি? এরা সামন্ত জমিদারদের পারিবারিক ভূমিদাসের মতো চিরকালের জন্য কর্পোরেট সংস্থার চুক্তিদাস হয়েই এক অচলায়তনে বাধা পড়বে কি? তখন কৃষি ও কৃষকের এবং আমাদের ভোক্তাদের উপায় কি হবে? এখনও আমাদের কৃষি-শ্রমিকরা, যারা ভাগ-চাষী বা বর্গাচাষী তারা বছরের পর বছর ভূমি মালিকের পরিবারের বাধা চাষী। ওরাই তাদের অসহনীয় শ্রম দ্বারা ভূমি মালিক পরিবারের সদস্যদের সচ্ছল জীবন, উন্নত শিক্ষা ও উন্নত জীবনের সবরকম সুযোগ-সুবিধা-মানসম্মত সামাজিক-সংস্কৃতিক চর্চা নিশ্চিত করে। এই দাস শ্রম থেকে সৃষ্ট একটা প্রজন্ম যখন ধনী হয়ে উঠল, তখন কিন্তু আমাদের দুঃখী চাষী পেট ভরে দু’বেলা সপরিবারে ভাত খেতে পেত কিনা, এ প্রশ্ন থেকেই যায়, তাদের সন্তানদের শিক্ষা তো দূরঅস্ত। নতুবা, ভারতে তেভাগা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাঁওতাল প্রজাদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে মনি সিংহ, ইলা মিত্র এগিয়ে আসতেন না। চাষী-কৃষকদের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের জন্মের সময়ে ‘নকশালবাড়ি’ আন্দোলনে সে সময়ের অসাধারণ মেধাবী কলকাতার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আত্মাহুতি, পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়া, জেলে অন্তরীণ থাকা, তাদের ছাত্রত্বের করুণ সমাপ্তিতে জীবন শেষ করার প্রবল আকাক্সক্ষা এই বাংলায়ও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল। যদিও শিলিগুড়ি বা উত্তরবঙ্গ, কলকাতা, পরিশ্চমবঙ্গের মেদিনীপুরে কৃষকের অধিকার আদায়ের জন্য যে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, প্রেসিডেন্সির কলেজের মেধাবী ছাত্রেরা যেভাবে কৃষকের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবনকে মৃত্যুর পায়ের ভৃত্যে পরিণত করেছিল, তেমন বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতো আন্দোলন এদেশে গড়ে ওঠেনি। সম্ভবত ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ব্রতের পর পর তেমন আরেকটি আন্দোলন সম্ভবও ছিল না। ‘সর্বহারা’, ‘জনযুদ্ধ’ নামে কিছু আন্দোলন বাংলাদেশের দক্ষিণে ও পশ্চিমে অল্প অল্প দানা বাঁধলেও পরে এদের নেতৃত্ব থেকে শিক্ষিত, প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বা শ্রেণীবৈষম্য বিরোধী মানসিকতা ধারণকারী নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দেখা গেল। ক্রমে ক্রমে এই কৃষকবান্ধব রাজনীতির স্থলে ব্যক্তি হত্যা, খুনোখুনি, ডাকাতি, লুটপাট ইত্যাদি স্থান করে নিলে এ রাজনীতি গ্রহণযোগ্যতা হারায় সবার কাছে। পরে সিপিবির উদ্যোগে ক্ষেত-মজুরদের অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে তৃণমূলে কাজ করার সূচনা হয়। দুই দশকের মতো উত্তরবঙ্গে ক্ষেত মজুরদের নিয়ে কিছু কাজ হয়। পরে, তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক চাষাবাদ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিতে নানামুখী বৈচিত্র্যপূর্ণ গবেষণার ফলে শস্য ও সবরকম কৃষিপণ্য বাজার-বাণিজ্যমুখী হয়ে পড়লে ‘ক্ষেতমজুর’দের কাজকর্ম ভিন্ন চরিত্র ধারণ করে। এরই মধ্যে, প্রবাসে অর্থাৎ, বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে থাকে। দেশে গার্মেন্টগুলোতে শ্রমিকের প্রয়োজন পড়লে ক্ষেত থেকে সরে এসে বহু শ্রমিক একদিকে বিদেশ পাড়ি দেয়, অন্যদিকে দেশে বস্ত্র কারখানায় কাজে যোগ দেয়। গ্রামীণ শ্রম, কৃষিভিত্তিক শ্রম ভিন্নরূপ ধারণ করে, যা অনেকাংশেই বাণিজ্যমুখী ও পুঁজি নির্ভর হলেও কৃষি ও কৃষক থেকে যায় পুরোপুরি স্বাধীন। তবু, এখনও শ্রমজীবীদের মধ্যে কৃষক বা বর্গাচাষী আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় অন্ন ও খাদ্য উৎপাদন করে বাজারে, আড়তে সরবরাহ করে। ওরাই দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত করেছে। ওদেরকে কর্পোরেট সংস্থার ‘কেনা-গোলাম’ যেন আমরা না করি। আড়তদারদের ঠেকানোর অনানুষ্ঠানিক প্রথায়- রেশন, টিসিবি, ১০/- টাকার চাল, ঋণ সুবিধা দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। ডিজিটাল কোন ব্যবস্থায় আড়তদারদের আনার চেষ্টা করা উচিত হবে না। কৃষি ও কৃষককে, সে সঙ্গে ভোক্তাকে মজুদদার-আড়তদারদের হাত থেকে বাঁচাতে দেশীয় প্রচলিত প্রথাগুলোর সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সৃজনশীল পন্থাও আবিষ্কার করতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×