ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যাব, পুলিশ ও নৌবাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা

রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু ॥ উখিয়া থেকে ভাসানচর

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ৪ ডিসেম্বর ২০২০

রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু ॥ উখিয়া থেকে ভাসানচর

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচ এম এরশাদ ॥ নানা ষড়যন্ত্র, বাধা বিঘ্ন ও প্রতিবন্ধকতা এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পে স্থানান্তর শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। এ অবস্থায় উখিয়া-টু-ভাসানচর স্থানান্তরের এ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে দুই মানবাধিকার সংস্থা। এর একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও অপরটি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (এআই)। এ জাতীয় আহ্বানের কোন ভিত্তি নেই বলে সরব আওয়াজ উঠেছে দেশের বিভিন্ন মহলে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেয়া হয়নি। সমস্ত প্রক্রিয়া চলছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়সহ মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকছে। থাকার উন্নত পরিবেশের স্বার্থে সরকার তাদের উখিয়া টেকনাফ থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে উন্নত আবাসনস্থলে প্রেরণ করছে মাত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৮ নবেম্বর ভাসানচরে ২২ এনজিও সংস্থার পরিদর্শনের পর সবুজ সঙ্কেত পাওয়া যায়। এরপর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে রহস্যজনক কারণে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় এবং এইচআরডব্লিউ ও এ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিরোধিতায় নেমেছে। বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়া থেকে কয়েক পর্বে ২০টি বাসযোগে রোহিঙ্গা সদস্যদের চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিএনএস ঈশা খাঁ ঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে রাত যাপনের পর শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নৌবাহিনীর বিভিন্ন জাহাজ ভাসানচরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়ার কর্মসূচী রয়েছে। এর আগে উখিয়া ডিগ্রী কলেজ ক্যাম্পাসে এনে রোহিঙ্গাদের জড়ো করা হয়। যারা যেতে ইচ্ছুক মূলত তাদের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসা হয়। এ কাজে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। আর এনজিওদের ছিল সহযোগিতা। এ সহযোগিতা দিচ্ছে ২২টি এনজিওর পক্ষে। সকাল সাড়ে ১১টায় প্রথম দফায় ১০টি বাস বোঝাই হয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। এরপরের দলের জন্য আরও ১০টি বাস অপেক্ষমাণ থাকে বেলা পৌনে ১টার দিকে। এ ১০টি বাস চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। রোহিঙ্গাদের বহনকারী বাসগুলোর সামনে ও পেছনে র‌্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে বলপ্রয়োগে বিতাড়িত বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় এর কোন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দেননি। স্থানীয়দের সূত্র জানিয়েছে, ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বুধবার রাতেই উখিয়ার কুতুপালং সংলগ্ন ঘুমধুম ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হয়। রাতেই জড়ো করা হয় উখিয়া ডিগ্রী কলেজ ক্যাম্পাসে যেখানে স্থানান্তরের জন্য জড়ো করা হয় বাস। উল্লেখ্য, এর আগে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা নবেম্বরের শেষ দিকে বলেছিলেন, ডিসেম্বর মাসের সপ্তাহান্তে রোহিঙ্গাদের একটি দলকে ভাসানচরে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। উখিয়া টেকনাফে রোহিঙ্গাদের আশ্রিত ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যারা যেতে ইচ্ছুক তাদেরই নেয়া হচ্ছে। শরণার্থী শিবির ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে তারা আগ্রহী হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে তাদের বিভিন্ন মালপত্র আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। মোদ্দা কথা ভাসানচরের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে সম্যক ধারণা পাওয়ার পর যারা আগ্রহী হয়েছে শুধু তাদের ভাসানচরে নেয়া হচ্ছে। নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার পর নিরাপত্তার জন্য ২৩১ পুলিশ-এপিবিএন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর বহু আগে থেকেই ক্ষুদ্র বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পুলিশ দল সেখানে পাহারা দিয়ে আসছে। প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, আজ এবং আগামীকাল দুই দিনে ৩০০ পরিবারের আড়াই হাজার রোহিঙ্গা সদস্যকে ভাসানচরে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা নেতাদের ভাসানচর পরিদর্শনে নেয়া হয়। ভাসানচর প্রকল্পে অবকাঠামো সরেজমিন দেখানো হয়। এরপর তারা ক্যাম্পে ফিরে এসে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের কাছে তাদের মত প্রকাশ করেন। নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শেষে রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ও কাল প্রথম দফায় রোহিঙ্গা দল ভাসানচরে যাচ্ছে। আজ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে নৌবাহিনীর জাহাজযোগে এদের সকাল ৯টায় নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচী রয়েছে। একটি সূত্রে জানানো হয়েছে, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে এবং আস্তে আস্তে লাখ খানেক রোহিঙ্গাকে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় শিবির থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে। উখিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের যেভাবে চট্টগ্রামে আনা হয়েছে ॥ উখিয়ার টিএ্যান্ডটি ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত নাগাদ রোহিঙ্গা বোঝাই ২০টি বাস চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় ২৪৮ পরিবারের হাজার খানেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো শুরু হবে আজ। স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়ে স্ব-স্ব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উখিয়া থেকে নতুন ঠিকানায় যাচ্ছে এসব রোহিঙ্গা। বৃহস্পতিবার সকালে ২০টি চেয়ারকোচে করে তারা উখিয়া থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়। ভাসানচরের অবকাঠামো ও সামগ্রিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা শিবিরে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে বসবাসযোগ্য বলে ধারণা দেন। সরকারী বিভিন্ন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা গত নবেম্বরে ভাসানচরে আবাসন গৃহসমূহের বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এসে আশ্রয় ক্যাম্পে প্রচার করার পর স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতাই রোহিঙ্গাদের প্রথম বহর বৃহস্পতিবার সকালে ভাসানচরে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় ক্যাম্প থাকলেও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরের উদ্দেশে রওয়ানা হয় রোহিঙ্গাদের প্রথম বহর। উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরকালীন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে র‌্যাব-৭ ও র‌্যাব-১৫। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা র‌্যাব-১৫ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখা গেছে। অনেককে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। প্রথম দফায় আপাতত এক হাজার জনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্য রোহিঙ্গারাও যাবে। রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রমকে ঘিরে স্থল ও আকাশপথে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পুরো প্রক্রিয়া র‌্যাবের ২৮টি টহল দল কার্যক্রম চালাচ্ছে। আকাশপথে হেলিকপ্টার রয়েছে। প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সাদা পোশাকে প্রায় ১৫০ জনের মতো র‌্যাব সদস্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প অভ্যন্তরে কাজ করছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার পক্ষ ইতোমধ্যে দু’দফায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি অবাস্তবায়িত থাকায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর জন্য মিয়ানমার সরকার বহুলাংশে দায়ী। এমন পরিস্থিতির মধ্যে উখিয়া টেকনাফে স্থাপিত ক্যাম্পগুলোর ওপর চাপ কমানোর অংশ হিসেবে প্রথম দফায় প্রায় ২৪৮ রোহিঙ্গা পরিবারকে ২০টি বাসে করে ভাসানচরে প্রেরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য ৩১০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার বাঁধ দেয়া হয়েছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী ১২০ টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এ প্রকল্প সম্পন্ন করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, গত নবেম্বর মাসে উখিয়া-টেকনাফ থেকে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নানা অপপ্রচারের কারণে এবং কিছু এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কারণে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা নেতারা সরেজমিনে ভাসানচর পরিদর্শনের পর সকল ধোঁয়াশা সরে যায়। ইতোমধ্যে ২২টি এনজিও সংস্থার পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ করা হয়েছে। উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ এর হেডমাঝি মোহাম্মদ নূর, ক্যাম্প-২০ এর মোহাম্মদ হোছন ও ক্যাম্প-৫ এর জাফর আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ক্যাম্প-২০ এবং ২০ এক্সটেনশন থেকে ৮ রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যাচ্ছে। মোঃ নূর জানান, তার ক্যাম্প থেকে ৭০ পরিবারের নাম দেয়া হয়েছে। প্রথম দফায় ৯ পরিবার ভাসানচরে যাচ্ছে। সূত্রে জানা গেছে, পালংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ১৩ পরিবারের ৫৬ জন। বালুখালী পানবাজার ক্যাম্প থেকে ২৩ পরিবারের ১১০ জন। শামলাপুর ক্যাম্পের ৫ পরিবারের ২৭ জন। কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ৯ পরিবারের ৪৫ জন। নয়াপাড়া ২ পরিবারের ১০ জন যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫২ পরিবারের ২৪৮ জনসহ প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচর নেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে ২৩ নং ক্যাম্পের মাঝি আবুল হাশেম বলেন, ভাসানচরে যাওয়ার জন্য কোন ধরনের জোর দেয়া হচ্ছে না। যারা স্বেছায় যেতে ইচ্ছুক তাদের নেয়া হচ্ছে ভাসানচরে। গতরাত থেকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে উখিয়া কলেজ ক্যাম্পাসে (ট্রানজিট) নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাদের নাস্তা ও খাবার পরিবেশন শেষে করোনা পরীক্ষা শেষে বাসে তোলা হয়। প্রতিটি বাসে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচর যাচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান মিলেনি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বশীল কেউ এ পর্যন্ত মুখ খুলছেন না। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নিয়ে যাওয়ার জন্য উখিয়ায় যে ব্যাপক আয়োজন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবত করা হয়েছে তা চোখে পড়ার মতো। এদিকে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পৌঁছানোর জন্য চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪ জাহাজ। ভাসানচরে পৌঁছানোর পর সেখানকার ১ নং ঘাট দিয়ে নামানো হবে। এবং নির্মিত ভবনগুলোতে নেয়া হবে। স্থানান্তর স্থগিত রাখতে দুই মানবাধিকার সংস্থার আহ্বান ॥ এদিকে বৃহস্পতিবার পৃথক পৃথক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (এআই)। এই দুই সংস্থার পক্ষে পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে শীঘ্রই রোহিঙ্গাদের প্রত্যন্ত ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করা। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম বন্দর নগরী হয়ে ভাসানচরে পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এইচআরডব্লিউর পক্ষ থেকে আহ্বানে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, সেখানে স্থানান্তরে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি সম্মতি গ্রহণ এবং জাতিসংঘের কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন বিবেচনা করতে হবে। মানবাধিকার বিষয়ক এই দুই সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে বৃহস্পতিবার প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেছে, ৩ ডিসেম্বর থেকে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। বাংলাদেশের উচিত একটি স্বচ্ছ, স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা। এর পাশাপাশি ভাসানচরের ভেতরে বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা থাকতে হবে। ভাসানচরে এদের স্থানান্তরের আগে স্বাধীন কারিগরি ও সুরক্ষাগত যে মূল্যায়নের আহ্বান জাতিসংঘ জানিয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে মনোযোগী হতে হবে। এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এ্যাডামস বলেন, মানবিক বিশেষজ্ঞদের সবুজ সঙ্কেতের আগে কোন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর না করার বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে বাংলাদেশ সরকার সক্রিয়ভাবে সরে যাচ্ছে। সরকার যদি দ্বীপটির বসবাসযোগ্যতা সম্পর্কে সত্যিই আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে এ বিষয়ে তাদের স্বচ্ছ হওয়া উচিত। অন্যদিকে, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থানান্তর বন্ধ করা উচিত। যারা ইতোমধ্যেই সেখানে আছে, তাদের মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনা উচিত। এছাড়াও, স্থানান্তরের যে কোন পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পূর্ণ ও অর্থবহ অংশগ্রহণসহ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন সাদ হামাদি। এ প্রসঙ্গে এ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ ও অবহিতপূর্বক সম্মতি ছাড়া তাদের ভাসানচর বা অন্য কোন জায়গায় স্থানান্তরের কোন পরিকল্পনা নেয়া যাবে না। ওদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিষয়ে গত ২ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যও নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন প্রাসঙ্গিক, নির্ভুল এবং হালনাগাদ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিয়েছে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী বর্বর অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতের পর রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুর দল বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবিক কারণে সরকার তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করে যা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। যদিও জাতিসংঘের মতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতের পর সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
×