ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইমন মাহমুদ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ॥ দুই যুগে পদার্পন আবৃত্তি সংগঠন ‘ধ্বনি’

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ১৫ নভেম্বর ২০২০

জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ॥ দুই যুগে পদার্পন আবৃত্তি সংগঠন ‘ধ্বনি’

শব্দের জাহাজে ভর করে কবি কল্পনায় ছুটে চলেন কবিতার গভীর সাগরে। স্রোতের ছন্দে ভাসতে ভাসতে কবির শব্দের বহর একসময় তীর খুঁজে পায়। কবির যাত্রা সাঙ্গ হয়। কবিতার যেখানে শেষ, শব্দেরা যেখানে নোঙর ফেলে, সেখানেই যাত্রা শুরু করেন একজন আবৃত্তিকার। তিনি একজন দক্ষ নাবিকের ভূমিকায় হাজির হয়ে কবির সৃষ্টিকর্মকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে চলেন ভিন্ন এক মোহনায়। যেখানে আবেগ আছে, আছে জীবনের উচ্ছ্বাস। কথায় আছে,‘আবৃত্তি সর্ব শাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী।’ অর্থাৎ আবৃত্তি বোধ সব শাস্ত্রের বোধের চেয়েও গৌরবের। আবৃত্তিকারের কাজ হলো কবিতার মজ্জায় মিশে গিয়ে কবির ভাবটাকে অনুধাবন করা এবং তা নিপুণ দক্ষতায় শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে যারা কবিতাবিমুখ, তাদের মধ্যে কবিতার প্রতি ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে কাজ করে আবৃত্তিশিল্পীরাই। একজন আবৃত্তিশিল্পী নৈপুণ্যময় আবৃত্তির মাধ্যমে শ্রোতাদের শ্রুতি-অনুভবে এবং চোখের সামনে কবিতার চিত্রকল্পকে উপস্থাপন করতে পারেন সহজেই। আর সে কারণেই আবৃত্তিকার একজন শিল্পী এবং আবৃত্তি একটি শিল্প। বর্ষার কোন এক বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় টিএসসির কাশেম ভাইয়ের দোকানে চা খেতে খেতে হয়ত আপনার কানে ভেসে আসবে তরুণ আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি অথবা নবীনদের শুদ্ধ শব্দ উচ্চারণের অবিরাম প্রচেষ্টা। ঝুম বৃষ্টিতে মেঘেরা যখন বিষাদের অর্কেস্ট্রা বাজায়, বইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে থাকা নবীন প্রাণগুলো ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে। টিএসসির বারান্দায় গিটারের টুংটাং শব্দ ঝড় তোলে চায়ের কাপে। কবিতার আকুলতা কড়া নাড়ে হৃদয়ের ডাকবাক্সে। সঙ্গীত এবং আবৃত্তির নৈঃসর্গিক মিথস্ক্রিয়ায় পুরোটা সময় বর্ষা বন্দনার এক অদ্ভুত আমেজ তৈরি করে ধ্বনির সদস্যরা। আবৃত্তির সময়টুকু কাটে মুগ্ধতার আবেশে। ঠিক এ রকমই একটি বিকেল ভাল করে দিতে পারে আপনার মন। বর্ষাকে নতুন করে ভালবাসার খোরাকও জোগাতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংগঠন ‘ধ্বনি’ সাংগঠনিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৯৬ সালের ১২ অক্টোবর। যাদের স্লোগান ‘দিগন্তে চলো শব্দ যেথায় সূর্য সত্য’। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রর ৯ নম্বর কক্ষই তাদের ঠিকানা। চলতে চলতে দুই যুগ পার করে ফেলেছে সংগঠনটি। দুই যুগের পথচলায় অনেক দক্ষ কর্মীর ত্যাগে, শ্রমে ও ভালবাসায় ধ্বনি এখন বিশ^বিদ্যালয়ের একটি পুরোধা সাংস্কৃতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ধ্বনির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইমরান শাহরিয়ার জানান, পড়ালেখার পাশাাপশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা একজন শিক্ষার্থীকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করে। আবৃত্তি চর্চা ও শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা উচ্চারণে উৎসাহী করতে কাজ করে যাচ্ছে ধ্বনি। এখানে মূলত শেখানো হয় শুদ্ধ উচ্চারণ, কবিতার ভাব ও রস, ছন্দ, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠের মত বিভিন্ন বাচিক শিল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ। বছরজুড়েই নানা আয়োজনে ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখেন ধ্বনির সদস্যরা। পাশাপাশি আয়োজন করে থাকেন আবৃত্তি সহায়ক অনেক কর্মশালা। বছরের শুরুতে নবীন শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিয়ে থাকেন কবিতার মন্ত্রে। শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর জন্য প্রতিবছর আয়োজন করে থাকেন ‘আবৃত্তি ও বাক-উৎকর্ষ’ বিষয়ক মাসব্যাপী কর্মশালা। আরও কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সাপ্তাহিক কবিতা পাঠের আসর। মাসিক কবিতা মঞ্চায়ন অনুষ্ঠান ‘জ্বালো ঐতিহ্যের আলো।’ চেতনা, প্রতিবাদে আবৃত্তির যে ঐতিহ্য সেটাকে পুনরায় জ্বালানোর জন্য, উজ্জ্বীবিত রাখার জন্য ঐতিহ্য অনুসারে এই অনুষ্ঠানের নাম ‘জ্বালো ঐতিহ্যের আলো’। এর বাইরে আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন ও গুণী শিল্পীদের সম¥াননা দেন তারা। আর নানা দিবস উপলক্ষে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন তো আছেই। জাতীয় আবৃত্তি উৎসব এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবেও অংশ নিয়ে থাকেন এই সংগঠনের সদস্যরা। ২০১৯ সালে কণ্ঠ বুয়েট আয়োজিত আন্তঃবিশ^বিদ্যালয় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দলগত ইভেন্টে ধ্বনি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে। দিন দিন ধ্বনির আবৃত্তি শিল্পীদের আবৃত্তির মন্ত্রণা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী। করোনাকালেও থেমে নেই তাদের কর্মযজ্ঞ। ‘ইথারে ইথারে প্রতিধ্বনিত হোক মুক্তির পয়গাম’ সেøাগানে গত ১১-১২ অক্টোবর অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই অনুষ্ঠিত হয় ‘দুই যুগ পূর্তি আবৃত্তি উৎসব ২০২০।’ ‘আবৃত্তির নির্দিষ্ট কোন কোন ক্লাসরুম হয় না। নিজের খুশিতেই আমার কবিতার পথে চলা শুরু। পরে আমার পাশে পেয়েছি ধ্বনির অগ্রজ আবৃত্তিকারদের। আমি ধ্বনি পরিবারের এই বিরাট ক্লাসরুমেরই অংশ। একেকটা জিনিস আমাদের একেকভাবে দেয়। ধ্বনি আমাদের যা দিয়েছে তা ভুলবার নয়। টিএসসির ৯ নম্বর কক্ষটি ছিল আমাদের আবেগ, আস্থা এবং ভালবাসর জায়গা। বিশ^বিদ্যালয়ে ধ্বনি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নয় শুধু, এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও নাম,’ কথা হচ্ছিল ইতিহাস বিভাগের ৩১ ব্যাচের ছাত্র সোহেল কামরুলের সঙ্গে। যিনি একসময় ধ্বনির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বিশ^বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েছেন ১০ বছর আগেই। তবুও নিজেকে এখনও ধ্বনি পরিবারের সদস্য হিসেবেই ভাবেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঞ্চাশেরও অধিক সাড়া জাগানো প্রযোজনা মঞ্চে এনেছে ধ্বনি। ধ্বনির উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে রয়েছে দেবদাস, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, বিক্ষত বাংলা, বারুদ নয় ফুলের সুবাস, কালো মানুষের কথা, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি । আবৃত্তিপ্রেমী মানুষের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। এই ধরনের আবৃত্তির অনুষ্ঠানগুলো আবৃত্তির সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে আবৃত্তিপ্রেমী মানুষগুলোকে আনন্দদানে সক্ষম।
×