ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৫ নভেম্বর ২০২০

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) রশীদ যখন বুঝতে পারল এ ঘটনা বেশিক্ষণ চাপা থাকবে না এবং পূর্বের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের আওতায় এটা পড়বে না, তখনই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা তাকে গ্রাস করল। ফলে পূর্বের অনড় সিদ্ধান্ত বজায় রাখার সাহস রইল না। সে বুঝতে পারল, এ ঘটনা প্রকাশ পেলেই একদিকে জনতার বিরাগভাজন হতে হবে, অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের রোষানলে পড়তে হবে। কাজেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক সময় অপচয় না করে আপাতত দেশের বাইরে যাওয়াই শ্রেয়। আর তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে খন্দকার মোশতাককে দিয়ে খালেদ মোশাররফ থেকে তারা সম্মতি আদায় করে নেয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান কোন অজ্ঞাত কারণে ঘটনাটি চেপে যান এবং তিনি অন্য কাউকে এ বিষয়ে জানতেও দেননি। এমনকি সেনানিবাসেও জানতে দেননি কাউকে। আর এ ঘটনা যখন খালেদ মোশাররফ ও সাফায়াত জামিল জানতে পারল তখন রশীদ, ফারুক, ডালিম ও মোসলেম দেশের বাইরে ব্যাংককে। জেলহত্যা প্রসঙ্গে বইটিতে বলা হয়, ২ নবেম্বর রাত ১২টার পর ৩ নবেম্বরের প্রথম প্রহরে যখন খালেদ মোশারফের পাল্টা অভ্যুত্থানের খবর বঙ্গভবনে পৌঁছে, তখন থেকেই সেখানে অবস্থানরত লেন্সার সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সমগ্র বঙ্গভবনে ছড়িয়ে পড়ে এক অজানা আশঙ্কা। এ উত্তেজনা ও আশঙ্কার মধ্যেই ভোর ৪টার দিকে ডিআইজি প্রিজনের তরফ থেকে একটি ফোন আসে। ফোনটি রশীদ রিসিভ করলে ওপাশ থেকে ফোনটি রাষ্ট্রপতিকে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। ডিআইজি প্রিজনের অনুরোধে রশীদ ফোনটি দেন রাষ্ট্রপতিকে। রাষ্ট্রপতি টেলিফোন ধরে তার সম্মতি জানিয়ে তড়িঘড়ি ফোনটি রেখে দেন। টেলিফোনে রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেয়ে ডিআইজি প্রিজন গেটে উপস্থিত রিসালদার মোসলেমের নেতৃত্বে সুসজ্জিত কয়েকজন সৈনিককে সশস্ত্র অবস্থায় জেলের ভেতর প্রবেশাধিকার দেন। কিন্তু তখনও ডিআইজি প্রিজন সশস্ত্র অবস্থায় এই সৈনিকদের জেলে আগমনের হেতু জানতেন না। মোসলেম উদ্দিন জেলের ভেতরে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের চার নেতাকে তার কাছে হস্তান্তরের দাবি জানায়। এবার আরেকবার ডিআইজি প্রিজন অসম্মতি জানালে মোসলেম জানায়, তার জেলে আসার কার্যক্রমের সম্মতি বঙ্গভবনে অবস্থানরত রশীদ ও রাষ্ট্রপতির রয়েছে। ডিআইজি মোসলেমের এই দাবিতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে আরও একবার বঙ্গভবনে যোগাযোগ করেন। এবারও রশীদ টেলিফোন ধরে তাকে মোসলেমের কথামতো কাজ করতে বলেন। কিন্তু ডিআইজি প্রিজন রশীদের কথায় সন্তুষ্ট না হতে পেরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তখন রশীদ আরেকবার টেলিফোন তুলে দেন রাষ্ট্রপতির হাতে। এবারও খন্দকার মোশতাক ডিআইজিকে মোসলেমের কথামতো কাজ করতে বলে টেলিফোন রেখে দেন। অগত্যা ডিআইজি মোসলেমের কথামতো মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সেলে নিয়ে আসেন। মোসলেম চারজনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে নির্দয়ভাবে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় হত্যা করে। এভাবেই দেশের সর্বোচ্চ অফিসের সম্মতিতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম কাপুরুষোচিত হত্যা, যা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসকেও কলঙ্কিত করে। যেভাবে সেনাসদরে এলো জেলহত্যার খবর-৪ নবেম্বর সকালে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলে অফিসাররা খালেদ মোশাররফ ও সাফায়াত জামিলের অপেক্ষায়। তাদের আগ্রহ ১৫ আগস্টের হোতাদের দেশ ছাড়ার পরবর্তী পদক্ষেপ জানা। সকাল ৯টার দিকে সাফায়াত জামিল এসে পৌঁছান। আরও কিছুক্ষণ পর খালেদ মোশাররফ এনএসআই প্রধান ই এ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কের রুমে প্রবেশ করেন। সেখানেই সেনা অফিসাররা প্রথমবারের মতো ই এ চৌধুরীর মুখে গত রাতের নারকীয় জেল হত্যার কথা শোনেন। এ সংবাদ বোমা বিস্ফোরণের মতো সকলকে হতবাক করে দেয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর খবর শুনে সাফায়াত জামিল উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি খালেদ মোশাররফকে অন্যান্য চীফ সহকারে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা এবং পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানান। ১১টার দিকে খালেদ মোশাররফ ই এ চৌধুরীকে নিয়ে বঙ্গভবনে যান। তাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এসে যোগ দেন দুই বাহিনীর প্রধানও। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও জেনারেল ওসমানী আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। দিনভর কোন খবর না পেয়ে সন্ধ্যার পর সাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে এসে উপস্থিত হন। বঙ্গভবনে তখন মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছে। সাফায়াত জামিলের উপস্থিতির পর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। খালেদ মোশাররফ ও অন্যদের নির্বিকার বসে থাকতে দেখে সাফায়াত জামিল রাগে ফেটে পড়েন এবং কিছুটা উচ্চস্বরে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হন। জেলহত্যার খবর পেয়েও কেন কেবিনেট মিটিং চলতে দেয়া হচ্ছে তার ব্যাখ্যাও তিনি জানতে চান। মেজর জেনারেল খলিল এ ঘটনা জেনেও কেন নিশ্চুপ ছিলেন তার কৈফিয়তও চান তারা দুজন। এ নিয়ে তিনজনের মঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় এবং পুরো বঙ্গভবন তোলপাড় হয়ে যায়। সাফায়াত জামিল উত্তপ্ত অবস্থায় খুলিলুর রহমানকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে নিষেধ করেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যখন খালেদ মোশাররফের পদোন্নতির অনুমোদন হয়, ঠিক সেই সময় এনএসআই প্রধান মন্ত্রিসভা বৈঠকে খন্দকার মোশতাককে জেলহত্যার ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। ৩ নবেম্বর ভোরে সংঘটিত জেলা হত্যার খবর ৪ নবেম্বর সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রকাশ করা হয় ঘটনার ২৪ ঘণ্টার পর। খবর শুনে খন্দকার মোশতাক হতবাক হওয়ার অভিনয় করেন এবং চার নেতার মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এটা শোনার পর সাফায়াত জামিল আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি কয়েকজন অফিসার নিয়ে ঝড়ের বেগে কেবিনেট রুমে প্রবেশ করে খন্দকার মোশতাকের দিকে চিৎকার করে ইংরেজীতে বললেন, ‘আপনি খুনী ও ক্ষমতা দখলকারী। আপনি আর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। আমি আপনাকে গ্রেফতার করছি, আপনার ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই, এখনই পদত্যাগ করুন।’ এতে মন্ত্রিসভায় উপস্থিত সকলের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রীরা ভীত হয়ে পড়েন এবং খন্দকার মোশতাক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় জেনারেল ওসমানী কক্ষে প্রবেশ করে সাফায়াত জামিলকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তখন শাফায়াত জামিল জেলহত্যার ঘটনায় তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওবায়দুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর চার জাতীয় নেতার হত্যাকা- সারা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে নত করেছিল আমাদের। দুনিয়ার আর কোথাও জেলখানায় এই পর্যায়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতীয় নেতারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজনৈতিক দিক থেকে যে প্রতিরোধের আশা ছিল, এই হত্যাকাণ্ড সেটি শেষ করে দেয়। বাংলাদেশের জনগণ সারা পৃথিবীকে যে রকম অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিন উপহার দিয়েছে, একইভাবে কিছু কুলাঙ্গারের জন্য বিশ্ব ইতিহাসে কয়েকটি কলঙ্কিত দিনের অধিকারীও হয়েছে। ৩ নবেম্বর ঠিক তেমনি একটি দিন। (সমাপ্ত) লেখক : সাংবাদিক
×