ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এসআই আকবর এখনও অধরা

রিমান্ড শেষে কনস্টেবল টিটু কারাগারে, অন্যরা গ্রেফতার হয়নি

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২৯ অক্টোবর ২০২০

রিমান্ড শেষে কনস্টেবল টিটু কারাগারে, অন্যরা গ্রেফতার হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন আদালত। বুধবার ২৮ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে তাকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে সিলেট অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (ভারপ্রাপ্ত) বিচারক জিয়াদুর রহমানের আদালতে তাকে হাজির করা হয়। এর আগে পিবিআই দুফায় ৩ দিন ও ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে আদালতের বিচারক কনস্টেবল টিটুকে কারাগারে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ এসআই আকবরের পলায়নের বিষয়ে তদন্ত করতে পুলিশ সদর দফতর গঠিত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার আইজিপি ড. বেনজির আহমেদের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির প্রধান এআইজি (ক্রাইম এ্যানালাইসিস) মোঃ আয়ুব। পুুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে শুরুতেই পুলিশ বিভ্রান্তি ছড়নোর পথে এগোতে থাকে। রায়হানের পরিবার ও সচেতনমহল এই নিয়ে সোচ্চার হলে এখান থেকে সরে আসে পুলিশ। রায়হান নিহত হওয়ার পর প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আকবর রায়হনকে ছিনতাইকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে নিজে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। সুকৌশলে প্রমাণ মুছে ফেলার লক্ষ্যে ফাঁড়ির সিসি ক্যামরার হার্ডডিক্স পরিবর্তন করে ফেলা হয়। দেশব্যাপী ঘটনা জানাজানির পর আকবর গা ঢাকা দেয়। আকবর পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা ছিল তাদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। রায়হান হত্যার ঘটনা নিয়ে রাজপথের আন্দোলন মামলার তদন্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমনটাই মনে করছেন সচেতনমহল। শুরু থেকেই রায়হান হত্যাকা-ের তদন্ত কাজে উদাসীনতা ও অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত এসআই আকবরের পলায়ন, মামলার তদন্ত কাজে ধীর গতি, নির্যাতন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে বিলম্ব করার বিষয়টি রায়হানের পরিবারসহ সকলের মাঝে হতাশা ছড়াচ্ছে। আকবরের অপরাধ কর্মে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এসআই হাসান ও এএসআই এলাহীর। আকবর তাদের দিয়েই নানা বিতর্কিত ঘটনা ঘটাত বন্দরবাজার ফাঁড়িতে। রায়হানকে নির্যাতনের আগে ও পরে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। ইতোমধ্যে বিষয়টি ধরা পড়েছে পুলিশের তদন্তেও। এ কারণে এসআই হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার ও আশেক এলাহীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই এখনও এই দুইজনের মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করেনি। এছাড়া কনস্টেবল তৌহিদের মোবাইলে থেকে কল দিয়ে টাকা চাওয়া হয়েছিল রায়হানের মা সালমা বেগমের কাছে। সেই তৌহিদও এখনও গ্রেফতার হয়নি। তবে পিবিআই বলছে, মামলার তদন্তকালীন সময়ে যাকে প্রয়োজন মনে করা হবে তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এখন তাদের সব মনোযোগ আকবরের দিকে। পলাতক থাকা আকবরকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে। রায়হান হত্যার আলোচিত প্রেক্ষাপটে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে বিদায় হয়ে যাওয়া পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়ার স্থানে এসে যোগদান করেছেন পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ। মঙ্গলবার রাতে সিলেট পৌঁছে বুধবার দিনভর তিনি ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। তার বক্তব্য পলাতক এসআই আকবরকে গ্রেফতারে সবাই চেষ্টা করছে, যত দ্রুত সম্ভব সে গ্রেফতার হবে। পুলিশ হেফাজতে রায়হান হত্যাকা-ের ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত। এর সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা জড়িত থাকায় আমি লজ্জিত। এই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার এসাইনমেন্ট নিয়েই আমি সিলেটে এসেছি। অন্যদিকে রায়হান হত্যা মামলার কার্যক্রম যথানিয়মে চলছে। তিনি আরও বলেন, আমি নিজস্ব একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, সব কিছু গোছানো সম্ভব। তিনি বলেন, এসআই আকবরকে কেউ যদি মদদ দিয়ে থাকে সবাইকে শনাক্ত করা হবে। সম্পৃক্ততা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারাও মামলার আসামি হবেন। পলাতক এসআই আকবর প্রসঙ্গে নবাগত কমিশনার বলেন, পলাতক এসআই আকবরকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিট কাজ করছে। পুলিশের তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, রায়হানকে নির্যাতনের মূল হোতা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বরখাস্ত হওয়া সাব ইন্সপেক্টর আকবর। আকবরই রায়হানকে বেশি নির্যাতন করেছে। তার নির্দেশে অন্যরাও নির্যাতন করেছে। ঘটনার দিন রাতে নগরীর কাস্টঘর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল রায়হানকে। আর এ গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল এএসআই আশেক এলাহী। সে রায়হানকে আটক করে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আশেক এলাহী প্রথমে উর্ধতনদের কাছে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। রায়হানের মা সালমা বেগম জানানা, এখনও অনেক দোষী কর্মকর্তাকে রায়হান হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়নি। কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এএসআই আশেক এলাহীর নেতৃত্বে তার ছেলেকে আটক করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এ ছাড়া আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিল বন্দরবাজার ফাঁড়ির টুআইসি বরখাস্ত হওয়া এসআই হাসান উদ্দিন। আকবরের পর একদিনের জন্য এসআই শাহীনকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে শাহীনকে সরিয়ে নেয়া হলেও ফাঁড়ির দায়িত্ব দেয়া হয় পূর্বের টুআইসি হাসানকে। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের তদন্ত কমিটির কর্মকর্তাদের মতামতের আলোকে এসআই হাসানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এসআই হাসানের কাছে দায়িত্ব দিয়েই আকবর পালিয়েছে। এক্ষেত্রে হাসানের বিরুদ্ধে সহায়তার অভিযোগ মেলায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আকবর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও এসআই হাসান সিনিয়র কর্মকর্তাদের অবগত করেননি। এদিকে রায়হান খুনের ঘটনার যে মোবাইল নম্বরটি নিয়ে তোলপাড় সেই মোবাইল নম্বরের মালিক বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদ। ঘটনার পর তৌহিদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এখনও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। রায়হানের পরিবারের দাবি, তৌহিদের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে মা সালমা বেগমকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসার কথা জানানো হয়েছিল। তৌহিদের মোবাইল ফোনে রায়হান শেষবারের মতো কথা বলেছিলেন পিতা হাবিবউল্লাহর সঙ্গে। এ সময় রায়হান টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যাওয়ার আর্তনাদও করেন। ওইদিন ভোরে রায়হানের পিতা হাবিবউল্লাহ ফাঁড়িতে গিয়ে তৌহিদের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। এ সময় তৌহিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবরও। এখনও তৌহিদকে গ্রেফতার করা হয়নি। পিবিআই ইন্সপেক্টর মুহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্তকালে ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা মিলবে সবাইকে গ্রেফতার করা হবে।
×