ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চনাটক পাঁচ দশকেও পেশাদার হয়ে ওঠেনি

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ২৩ অক্টোবর ২০২০

মঞ্চনাটক পাঁচ দশকেও পেশাদার হয়ে ওঠেনি

মনোয়ার হোসেন ॥ মূলত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েই বিকশিত হয়েছে দেশের মঞ্চনাটক। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। তবে এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় স্বনির্ভর হয়নি থিয়েচার চর্চা। প্রতিষ্ঠিত হয়নি পেশাদারিত্ব। নাটক করে মঞ্চশিল্পীর জীবিকা অর্জনের বিষয়টি আজো অধরা। অন্য পেশায় আয়-রোজগারের ওপর নির্ভর করে চলছে নিবেদিত প্রাণ শিল্পীদের নাট্যচর্চা। শুধুমাত্র মঞ্চে অভিনয় করে তৈরি হয়নি রুটি রুজির পথ। মঞ্চশিল্পীর শ্রম-ঘাম ও ভালবাসায় শিল্পমাধ্যমটি বেড়ে উঠলেও হয়ে ওঠেনি তাদের জীবিকার উৎস। রূপসজ্জা শিল্পী কিংবা আলোক প্রক্ষেপণকারীসহ অনেকেই টাকা পেলেও বিনা পয়সায় কাজ করতে হয় অভিনয়শিল্পীকে। তাদের কাছে মঞ্চনাটক মানে যেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। অথচ এই শিল্পচর্চায় দায়বদ্ধতার অভাব নেই নাট্যকর্মীদের। নেই শুধু পেশাদারিত্ব। যুগের পর যুগ নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে চলছে এই শিল্পচর্চা। মঞ্চনাটক বিকাশের সূচনালগ্ন থেকেই পেশাদারিত্বের বদলে প্রাধান্য পেয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা। সেই অর্থে থিয়েটারকে পেশাদার করার নেতৃত্বও গড়ে ওঠেনি। কখনও কখনও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার বিক্ষিপ্ত কিছু প্রচেষ্টা নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। দীর্ঘ হয়েছে শুধু মঞ্চশিল্পীর দীর্ঘশ্বাস। লাভজনক থিয়েটারের আশায় গ্রুপ থিয়েটারের বাইরে কিছু রেপার্টরি দল প্রতিষ্ঠিত হলেও অর্জিত হয়নি লক্ষ্য। দিনশেষে টিকেট বিক্রির মাধ্যমে প্রদর্শনীর মিলনায়তন ভাড়া তুলে আনার মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছে সফলতা। প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে দেয়া যায় না শিল্পীর সম্মানী। অর্থপ্রাপ্তির বদলে দর্শকের করতালিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মঞ্চশিল্পীকে। ফলে অভিনয়শিল্পী সৃষ্টির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত মঞ্চনাটকের তরুণ থেকে প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে হতাশা। আছে নিজেকে উজাড় করে দিয়েও না পাওয়ার বেদনা। সব মিলিয়ে অলাভজনক শিল্পচর্চার উদাহরণে পরিণত হয়েছে মঞ্চনাটক। যুগের পর যুগ ধরে চলছে সেই ধারাবাহিকতা। কোন অর্থপ্রাপ্তি ছাড়াই শুধুমাত্র থিয়েটারকর্মীদের ভালবাসায় টিকে আছে শিল্পমাধ্যমটি। এমন বাস্তবতায় থিয়েটারচর্চাকে লাভজনক শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে নাট্যচর্চার শুরু থেকেই পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে এগোয়নি শিল্পমাধ্যমটি। এর নেপথ্যে রয়েছে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। পেশাদার থিয়েটারের জন্য প্রয়োজন ছিল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার। কিন্তু সরকারীভাবে মঞ্চনাটক কখনোই সেই পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। পাশাশাশি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। তাই মঞ্চনাটকের পেশাদারিত্ব আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। পেশাদার হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে গঠন করতে হবে জাতীয় নাট্যদল বা ন্যাশনাল থিয়েটার। পাশপাশি কোম্পানির আদলে গড়তে হবে নাট্যদল। সেই সঙ্গে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে নাট্যচর্চা করতে হলে নাট্যদলের সংখ্যা কমাতে হবে। বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় গড়ে উঠেছে অনেক নাট্যদল। নির্বাচিত নাট্যদলের মাধ্যমে বাড়াতে হবে নাটকের মান। দূর করতে হবে মঞ্চ সঙ্কট। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়তে হবে নতুন নাট্যমঞ্চ। মঞ্চের অভাবে চাইলেই নির্দিষ্ট সময়ে কোন সমাদৃত নাটকের একাধিক প্রদর্শনী করা যায় না। দর্শককে মঞ্চমুখী করতে হলে বাড়াতে হবে প্রচার। এছাড়া নতুন দর্শক তৈরির ক্ষেত্রে দূর করতে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা। মোকাবেলা করতে হবে মঞ্চনাটকের প্রতি উগ্রপন্থার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে। রামেন্দু মজুমদার ॥ এ বিষয়ে আইটিআইয়ের (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট) সাম্মানিত সভাপতি রামেন্দু মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, মঞ্চনাটকের পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার অন্যতম কারণটি হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। সেই পারিপার্শ্বিকতায় মঞ্চনাটক নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি। পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটা সম্ভবও নয়। কারণ পৃৃথিবীর অনেক বড় শহরে থিয়েটারের ৮০ শতাংশ খরচ চলে সরকারী-বেসরকারী সহায়তায়। বাকি ২০ শতাংশ আসে টিকেট বিক্রি থেকে। এমন অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থিয়েটার কোম্পানি গড়তে হবে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা এসব থিয়েটার কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা করবে। ফুটবল, ক্রিকেটসহ নানা খেলাধুলায় বিভিন্ন কোম্পানি যেমন বিনিয়োগ করে তেমনি নাট্যদলের জন্যও পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। গুণগতমানের ভিত্তিতে নির্বাচিত করতে হবে এসব নাট্যদল। এই কোম্পানিভিত্তিক বা সহায়তাপ্রাপ্ত দলগুলো হবে খুবই প্রতিযোগিতামূলক। যারা দক্ষ শুধুমাত্র তারাই টিকে থাকবে এই প্রক্রিয়ায়। তাছাড়া নাট্যচর্চা করে সবার পক্ষে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। কিছু লোকের পক্ষে সম্ভব। তাই যোগ্যরাই কেবল পেশাদার নাট্যচর্চার অন্তর্ভুক্ত হবে। সেক্ষেত্রে অভিনয়শিল্পী, নির্দেশকসহ ৩০ জনের একটি দলের সঙ্গে দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হবে। এই দুই বছর তাদের একটি নির্দিষ্ট অংকের বেতন দেবে ওই কোম্পানি। তার বিনিময়ে দলটি নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রযোজনা নিয়ে আসবে মঞ্চে। সেক্ষেত্রে ভাল কিছু মঞ্চনাটকও আসবে। এমনকি সরকারীভাবেও এটা করা যেতে পারে। শিল্পকলা একাডেমি জাতীয় নাট্যদল বা ন্যাশনাল থিয়েটার গড়তে পারে। বিভিন্ন দলের প্রতিভাবান শিল্পীদের গঠিত হবে সেই ন্যাশনাল থিয়েটা। মঞ্চনাটকের পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে এই নাট্যজন বলেন, প্রতিভা ও দক্ষতার তুলনায় বর্তমানে নাটকের দল অনেক। বছরজুড়ে যত নাটকের প্রদর্শনী হয় তার অর্ধেকই মানসম্পন্ন নয়। ফলে নাট্যদলের সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় দর্শক বাড়েনি। অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নাট্যমঞ্চের সঙ্কট থাকায় দর্শকসমাদৃত ভাল প্রযোজনার প্রদর্শনী কম হয়। এজন্য ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে থিয়েটার হল গড়ে তোলা অনেক জরুরী। পাশাপাশি মঞ্চনাটকের প্রচারও বাড়াতে হবে। নজর দিতে হবে নাটকের মানের দিকে। মামুনুর রশীদ ॥ স্বাধীনতা-উত্তর দেশের মঞ্চ আন্দোলনের পথিকৃৎ মামুনুর রশীদ। আক্ষেপ করে আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, পেশাদারিত্ব থাকলে আমি শুধুমাত্র মঞ্চনাটকেই কাজ করতাম। মঞ্চের প্রতি আমার যে মোহ আছে অন্য মাধ্যমের প্রতি সেটা নেই। কিন্তু জীবিকার তাগিদে টিভি নাটক, সিনেমাসহ নানা কাজ করতে হয়। আসলে মঞ্চনাটকের পেশাদারিত্ব নিয়ে কেউ কোনদিন ভাবেনি। সরকার বা কোন রাষ্ট্রনায়ক মঞ্চশিল্পীদের আবেগের জায়গাটি কখনও উপলব্ধি করেনি। কর্পোরেট কালচারেও পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি মঞ্চনাটক। ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের জন্য শ’ শ’ কোটি টাকা ব্যয় করলেও মঞ্চনাটকের জন্য কেউ পয়সা দিতে আগ্রহী নয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে তরুণ মঞ্চশিল্পীদের জন্য। প্রচ- ভালবাসা ও আবেগ নিয়ে তারা এই শিল্পমাধ্যমে কাজ করে। কিন্তু সেই ভালবাসার জন্য নেই কোন অর্থপ্রাপ্তি। শুধুমাত্র প্রশংসা কিংবা দর্শকের হাততালিতেই তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ এসব তরুণ থিয়েটার করেই জীবন চালাতে চায়। কিন্তু পারে না। মূলত সরকারী-বেসরকারী সহযোগিতার অভাবেই পাঁচ দশকেও পোশাদারিত্ব অর্জন করেনি মঞ্চনাটক। থিয়েটার হয়নি স্বনির্ভর। এর মূল কারণটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অথচ অনেক দেশেই থিয়েটারকর্মীরা সরকারীভাবে স্যালারি গ্র্যান্ট পায়। এমনকি পাশের দেশ ভারতের নাট্যকর্মীরাও এই সুবিধা পায়। আমাদের দেশেও এটা প্রচলিত হওয়া উচিত। যারা নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গে যুক্ত সেসব নাট্যদলের নাট্যকর্মীদের এই সুবিধার আওতায় আনা উচিত। পৃথিবীর কোথাও শুধুমাত্র টিকেট বিক্রির অর্থে পেশাদার মঞ্চনাটক হয় না। তাই পেশাদার হওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ মঞ্চনাটকের মান কমছে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ॥ সমাজ ও রাষ্ট্রের সহায়তার অভাবেই মঞ্চনাটকে পেশাদারিত্ব আসেনি বলে মনে করেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত এই নাট্য নিদের্শক আফসোস করে বলেন, যাত্রা দলগুলো পেশাদার কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও মঞ্চনাটকে সেটা হয়নি। এজন্য হয়ত আমাদেরও কিছু খামতি আছে। মূলত স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তাল সময়ে বেড়ে উঠেছে এই শিল্পমাধ্যমটি। সেই সময় পেশাদার নাট্যচর্চার বদলে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এটি মূল্য সমস্যা নয়। এই সঙ্কটের বড় কারণটি হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি কখনোই পেশাদার নাটকের সহায়কের ভূমিকা নেয়নি। থিয়েটারকে পেশাদার করতে হলে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। একটি ভালমানের প্রযোজনা মঞ্চে নামাতে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি প্রদর্শনীর মিলনায়তনের ভাড়া গুনতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তার আগে প্রতিদিনের মহড়ার জন্য আলাদা থাকে পৃথক ব্যয়। সঙ্গে যুক্ত হয় উচ্চমূল্যের বিজ্ঞাপন ও নাটকের বুকলেটের খরচ। এই অবস্থায় একটি দর্শকসমাদিত নাটক নামানোর পর চাইলেও একাধিক প্রদর্শনী করা যায় না। কারণ মিলনায়তনের সঙ্কট রয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকাতেই শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতি মিলিয়ে মাত্র চারটি নাট্যমঞ্চ রয়েছে। অথচ নাট্যদলের সংখ্যা কয়েকশত। ফলে কোন নাটকের প্রথম প্রদর্শনী শেষে দ্বিতীয় প্রদর্শনীর জন্য কমপক্ষে এক মাস অপেক্ষা করতে হয়। চাইলেই এক মাসে একটি দর্শকসমাদৃত নাটকের ২০টি শো করা যায় না। এসব কারণে নাটক করে আয় করার পরিবর্তে উল্টো নিজের পকেটের পয়সা খরচ করতে হয় মঞ্চশিল্পীকে। থিয়েটারকে সামাজিক বিনোদন হিসেবে ধরা হলেও এখানে নেই কোন আর্থিক নিশ্চয়তা। অবস্থার বিবেচনায় টিকেটের মূল্য বাড়ানোরও উপায় নেই। কারণ, একজন দর্শক যদি তার পরিবারসহ নাটক দেখতে উত্তরা থেকে শিল্পকলায় আসে যাতায়াতসহ এমনিতেই হাজার টাকা খরচ হয়। আবার ক্রমাগত নাটদলের সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় নতুন মঞ্চ হয়নি। সেই অর্থে ঢাকার বাইরে ভাল থিয়েটার হল নেই। অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে প্রতিটি বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি জেলা শহরেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সজ্জিত নাট্যমঞ্চ গড়তে হবে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে রাজধানীসহ আট বিভাগে আটটি পেশাদার দল তৈরি করতে হবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না। সর্বোপরি সরকার ও রাজনৈতিক দল এবং ব্যবসায়ীরা যতদিন না এগিয়ে আসবে ততদিন মঞ্চনাটকে পেশাদারিত্ব আসবে না। উল্টোদিকে সামাজিকভাবে মৌলবাদীদের অপব্যাখ্যায় নাটক করে এখন আর কেউ স্বস্তি পায় না। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। উগ্রবাদীদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা নাটক দেখা থেকে নিরুৎসাহিত করে দর্শককে। এসব কারণে থিয়েটার এখন আর সম্মানের পেশা হিসেবে বিবেচিত হয় না। সব মিলিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ধারণানির্ভর পেশাদার থিয়েটারচর্চার সুযোগ চরমভাবে সংকুচিত হয়েছে। সংগীতা চৌধুরী ॥ দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে মঞ্চে কাজ করছেন সংগীতা চৌধুরী। গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যচর্চার পাশাপাশি রেপার্টরি নাট্যদলে কাজ করা এই অভিনয়শিল্পী বলেন, নাটককে ভালবাসি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। তবে শুরু থেকেই এদেশে পেশাদার নাট্যচর্চা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যাত্রাশিল্পে যেমনটা হয়েছে নাটকে তেমনটা হয়নি। পেশাদার নাটক করার জন্য সঠিক নেতৃত্বও গড়ে ওঠেনি। এমনকি গ্রুপ থিয়েটার ও রেপার্টরি দলের মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। মঞ্চনাটকে কস্টিউম ডিজাইনার, রূপসজ্জা শিল্পী, লাইটম্যানসহ অনেকেই টাকা পায়। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পায় না। মঞ্চে অভিনয়ের জন্য নেই অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা; আছে শুধু মায়া, ভালবাসা আর মোহ। তাই এখন আর দর্শকের হাততালিতে মন ভরে না। বরং সেটাকে শব্দ দূষণ মনে হয়। মঞ্চের টানে অন্য কোন পেশায় ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠিত করিনি। চাইলেই সেটা পারতাম। থিয়েটারের জন্য ঢাকার দুটি নামী কলেজের শিক্ষকতার পেশাকে ত্যাগ করেছি। এখন নিজের অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছি। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও অনেক শিল্পী নাটক করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এদেশে সেটা সম্ভব হয়নি। অবস্থা এমন যে জীবন-যৌবন সব দিয়ে অভিনয়শিল্পী শুধু বেকার খাটবে। বয়সের ভারে যখন সেই শিল্পী আর পারবে না তখন তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হবে। এসব কষ্টের জায়গা থেকে মাঝে মাঝে মনে হয় থিয়েটার ছেড়ে দেই। কারণ এই শিল্পমাধ্যমটিতে কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। একপর্যায়ে থিয়েটারের প্রতি প্রবল আবেগকে বড্ড ফাঁপা মনে হয়। অন্যদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো নাটকের দল গজিয়ে উঠেছে। যাদের কোন ভাল প্রযোজনা নেই। নেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নতুন দর্শক তৈরির পরিবর্তে এসব দলের মানহীন প্রযোজনায় অনেকের অনাগ্রহ জন্মের মঞ্চের প্রতি। এই সময়ের মঞ্চের আলোচিত অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা। দুই দশকের বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন থিয়েটারচর্চায়। নিজ দল মনিপুরী থিয়েটারের পাশাপাশি কাজ ঋৎমঞ্চ নামের রেপার্টরি দলে। আক্ষেপ করে এই মঞ্চশিল্পী বলেন, সুযোগ পেলে শুধু মঞ্চনাটকই করতাম। কিন্তু সেই সুযোগটি নেই। অভিনয়ের পাশাপাশি জীবিকার প্রয়োজনে একটি চাকরি করি। চাকরির আগে নাটক করে সামান্য কিছু টাকা আয় করতাম। কিন্তু জীবন চালানোর জন্য সেটা ছিল অপ্রতুল। আসলে থিয়েটার করে পয়সা পাওয়া যায় না। পেশাদারিত্বের সেই জায়গাটি তৈরি হয়নি। এই শিল্পমাধ্যমটির জন্য বৃহৎভাবে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কয়েক দশকেও সেটা হয়নি। আবার বেসরকারী সহযোগিতাও পায়নি মঞ্চনাটক। তাই দিনকে দিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। কিছু মানুষ নিবেদিতভাবে কাজ করলেও নেই তার প্রতিদান। রামিজ রাজু ॥ ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করে আরেক সক্রিয় মঞ্চশিল্পী রামিজ রাজু বলেন, আমি আজীবন থিয়েটার করতে চাই। কিন্তু ঘরের খেয়ে আর বনের মোষ তাড়াতে চাই না। শুধু দর্শকের করতালিতে সংসার চলে না। সারাদিন অন্য কাজ করে বিকেল থেকে রাত অবধি মহড়া বা প্রদর্শনী করেছি বিনা পয়সায়। থিয়েটারকর্মীদের শ্রম-ঘামে মেশা ত্যাগের ওপর মঞ্চনাটক টিকে থাকলেও এই শিল্পে নেই যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা। অথচ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার নামের অপসংস্কৃতিতে ঠিকই পৃষ্ঠপোষকতা দেয় অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এখন উপলব্ধির সময় এসেছে যে, শুধুমাত্র আবেগ-ভালবাসা দিয়ে নাটক করা সম্ভব না। অন্য শিল্পের মতো এই শিল্পেরও মূল্য থাকতে হবে। আমাদের ব্যর্থতা যে, থিয়েটারকে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি। পেশাদার হওয়ার জন্য এই শিল্পের প্রচার ও প্রসারে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এক অর্থে আমরা পণ্যটা নিয়ে কাস্টমারের কাছে যেতে পারিনি। সেক্ষেত্রে পণ্যের মোড়কটা আকর্ষণীয় হতে হবে। অর্থাৎ মানসম্পন্ন নাটক নির্মাণের পাশাপাশি সেগুলোর যথার্থ প্রচারের মাধ্যমে দর্শকের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং সঠিক শিল্পমূল্য নির্ধারণ করতে হবে। মাসুম রেজা ॥ নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ধরে এদেশে থিয়েটারচর্চা হলেও এখনও পর্যন্ত এই শিল্পে গড়ে ওঠেনি পেশাদারিত্ব। এর নেপথ্যে রয়েছে শিল্পমাধ্যমটি বিষয়ে উপযুক্ত প্রচারের অভাব। প্রচারের অভাবে অনেক মানুষ হয়ত জানেই না যে প্রতিদিন রাজনধানীর কয়েকটি মঞ্চে নাটকের প্রদর্শনী হয়। অথচ এই শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। আর একটি মঞ্চনাটকের প্রদর্শনীতে তিন থেকে চার শ’ দর্শক হলেই শো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক দর্শককেও আমরা মঞ্চে নিয়ে আসতে পারছি না। প্রতিটি প্রদর্শনীতে পরিপূর্ণ দর্শক হলে কিছুটা হলেও স্বনির্ভর হতে পারত মঞ্চনাটক। তবে সেটাও হয়নি। কারণ এখানে কখনও পেশাদারী নাটক নিয়ে ভাবা হয়নি। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চস্থ হলেও সর্বোচ্চ হলো ভাড়া উঠে আসে। তাই প্রাপ্তির বদলে দলকে উলেটা দিতে হয়। রেপার্টরি দল গঠনের মাধ্যমে পেশাদার নাট্যচর্চার চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। সরকারী সহযোগিতা পেলে কিছুটা সফল হতে পারত। অন্যদিকে থিয়েটারের সহযোগিতায় কর্পোরেট কোম্পানিও এগিয়ে আসে না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পেশাদার থিয়েটার গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। সাইফ সুমন ॥ কিছু রেপার্টরি দল হলেও সেগুলোর মাধ্যমে পেশাদার নাট্যচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি বলে মনে করেন নাট্যনির্দেশক সাইফ সুমন। থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির এই সদস্য বলেন, এখানে পেশাদারী থিয়েটার হওয়ার কোন সুযোগও নেই। কারণ, পেশাদারী হওয়ার জন্য যেসব উপদান দরকার তার কোনটাই নেই রেপার্টরি দলগুলোর। এই কাঠামোতে প্রতিটি দলের নিজস্ব মিলনায়তন থাকতে হবে। শিল্পী ও কুশলীরে সম্মানী দেয়ার জন্য অর্থবল থাকতে হবে। এর কোনটাই নেই রেপার্টরি দলগুলোর। নামে রেপার্টরি হলেও চরিত্রগতভাবে সেগুলো রেপার্টরি হয়নি। তাই এদেশে পেশাদার থিয়েটার হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই। উল্টোদিকে দর্শক স্বল্পতার কারণে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কখনও মঞ্চনাটকের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে না। আবার দর্শক আসার মতো স্কিলড পারফর্মেন্সও আমরা দিতে পারছি না। কালেভদ্রে দু’একটি ভাল প্রযোজনায় হয়ত দর্শককে আকৃষ্ট করে। বাকিগুলো দর্শক টানে না।
×