ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে বছরে ১৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন সম্ভব

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১৯ অক্টোবর ২০২০

ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে বছরে ১৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন সম্ভব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের পর চায়ের চতুর্থ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির তালিকায় যুক্ত হলে এ অঞ্চলে ৫টি জেলার ১৫টি উপজেলার মোট ১৩ হাজার ৬৪৫ একর জমি চা আবাদের আওতায় আসবে। এসব জমি থেকে বছরে ১৬.৩৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হবে। এ অঞ্চলের চা আবাদের সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে বেশ কিছু স্থানীয় উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন। শেরপুর জেলায় চা চাষের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন বেসরকারী উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন ফনিক্স এর ‘গারো হিলস টি কোম্পানি’। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকজনকে এর মধ্যেই চা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের লক্ষ্যে এরই মধ্যে স্থানীয় ২৭ কৃষকের মাঝে ২৭ হাজার উন্নত জাতের চা চারা বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে চায়ের চারার রোপণ। ইতোমধ্যে শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলায় ৬, নালিতাবাড়ি উপজেলায় ৩, ঝিনাইগাতি উপজেলায় ১৩, নকলা উপজেলায় ৪, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় ১ কৃষক অর্থাৎ মোট ২৭ কৃষক ৫.৩১ একর জমিতে চা চাষ শুরু করছে। ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে চা চাষ সম্প্রসারণে ক্ষুদ্র চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণ ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ডের আওতাধীন বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলীসহ ৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম ১৭ অক্টোবর এবং ১৮ অক্টোবর বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতি, নকলা ও নালিতাবাড়ি এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় সৃজিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানসমূহ সরেজমিন পরিদর্শন করেন ও চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন। পরিদর্শনকালে বিশেষজ্ঞরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সহজ উপায়ে কিভাবে লাভজনকভাবে চা আবাদ করা যায়, জমিতে চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, গাছের পরিচর্যা, পাতা চয়ন, পোকামাকড়-রোগবালাই দমন ও কাঁচা চা পাতা দিয়ে হাতে চা তৈরি (হ্যান্ড মেড টি) ইত্যাদি বিষয়ে চাষিদের পরামর্শ প্রদান করেন। এছাড়া এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে চা চাষ বৃদ্ধির বিষয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও আগ্রহীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। চা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত নগরায়ন, জনতার শহরমুখিতা ও সামাজিক উন্নয়নের ফলে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। তবে বৃহদায়তনের চা বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বৃহৎ আকৃতির জমির প্রাপ্যতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ একটি লাগসই ব্যবস্থা হতে পারে। তাই চায়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বৃহৎ বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ সম্প্রসারণে দুই দশক ধরে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সরকার। ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষের পথিকৃৎ জেলা পঞ্চগড়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতোমধ্যে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় চা চাষে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ৮,৬৮০ একর জমিতে বছরে ৯.৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের চা চাষ জাতীয় উৎপাদনে অবদান রাখার পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড শুরু থেকেই চা চাষ সম্প্রসারণ ও চা আবাদ উপযোগী নতুন এলাকা অনুসন্ধানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে প্রণীত চা নীতিতে দেশের উত্তরাঞ্চলে ও ময়মনসিংহের পাহাড়ী এলাকাসমূহে প্রথম চা আবাদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে ১৭টি জেলা বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭২ হেক্টর চা চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক বছর ধরেই শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহে চা চাষের উপযুক্ততা নিয়ে কথা বলে আসছিলেন চা বিশেষজ্ঞরা। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের জেলাসমূহে চা চাষের সম্ভাবনা সরেজমিনে জরিপ করার জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক একটি টিম সরেজমিনে পরিদর্শন, মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করে ২০০৪ সালের ১০ জানুয়ারি একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন প্রদান করে। জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাহাড়ি এ জনপদের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া চা চাষাবাদের অত্যন্ত উপযোগী। ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট (১১২০ একর), শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী (১১৫০ একর), ঝিনাইগাতি (১৮৫৫ একর) ও নালিতাবাড়ি (২৫০০ একর), জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ (৬০০ একর), নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপূর (১৭৭০ একর) ও কলমাকান্দায় (১০৫০ একর) মোট ১০,০৪৫ একর জমিতে চা আবাদ সম্ভব। এছাড়া পরবর্তীতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় চা আবাদ সম্প্রসারণের নিমিত্ত প্রকল্প গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক গঠিত একটি টিম সরেজমিনে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে স্টাডি করে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রদান করে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা (৩০০ একর), ফুলবাড়িয়া (৫০০ একর), ভালুকা (৪০০ একর) ও টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর (৬০০ একর), ঘাটাইল (৫০০ একর), সখিপুর (৫০০) অর্থাৎ উক্ত উপজেলাসমূহে আরও ২,৮০০ একর ভূমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৫টি জেলার ১৫টি উপজেলায় মোট ১৩,৬৪৫ একর জমিতে চা আবাদ সম্ভব। উক্ত জমি চা আবাদের আওতায় আনা হলে বছরে এ অঞ্চল থেকে ১৬.৩৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হবে। জানা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো হিলের পাদদেশে চা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক ৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২৩৫ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণের নিমিত্তে ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ’ শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির যাচাই-বাছাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন উক্ত প্রকল্পের ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য পেশ করেছেন। আশা করা হচ্ছে, চা আবাদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
×