বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারীর সঙ্কট উত্তরণে বহুপাক্ষিকতাবাদের বিকল্প নেই উল্লেখ করে করোনার ভ্যাকসিন সকল দেশ যাতে সময় মতো ও একইসঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মহামারী বিদ্যমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ আরও প্রকট করেছে। এ মহামারী আমাদের উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে যে, এ সঙ্কট উত্তরণে বহুপাক্ষিকতাবাদের বিকল্প নেই। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে, আমাদের সকলের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই যতক্ষণ না আমরা সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি। তাই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে সকল দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন সময় মতো এবং একইসঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও মেধাস্বত্ব প্রদান করা হলে, এই ভ্যাকসিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আশ্রয় প্রদান করেছে। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এই সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মহামারীকালে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে পারি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিবারের মতো এবারও জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেন। সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় (নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০টা) তাঁর পূর্ব নির্ধারিত রেকর্ডকৃত ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর কারণে জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভার্চুয়াল অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি, ভ্যাকসিনের সমবণ্টন, রোহিঙ্গা সঙ্কট, করোনা মহামারী থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও দেশের মানুষকে রক্ষায় তাঁর সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নির্র্মূল, জলবায়ুজনিত ক্ষতি মোকাবেলার বিষয়গুলো বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন জাতিসংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের সকল দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, তেমনই এই মহামারী আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নেয়া সকল বিশ্ব নেতাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আমরা মানব ইতিহাসের এক অভাবনীয় দুঃসময় অতিক্রম করছি। জাতিসংঘের ইতিহাসেও এই প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কের সদর দফতরে সদস্য দেশসমূহের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণের অনুপস্থিতিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘের এই সভাকক্ষটি আমার জন্য অত্যন্ত আবেগের। ১৯৭৪ সালে এই কক্ষে দাঁড়িয়ে আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার প্রধান হিসেবে মাতৃভাষা বাংলায় প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন। আমিও এই কক্ষে এর আগে ১৬ বার সশরীরে উপস্থিত হয়ে বিশ্বশান্তি ও সৌহার্দ্যরে ডাক দিয়েছি। সরকার প্রধান হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে এটি আমার ১৭তম বক্তৃতা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতেই করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যকর্মীসহ সকল পর্যায়ের জনসেবকদের যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। একইসঙ্গে এই দুর্যোগকালে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবকেও ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ শুরু থেকেই যুদ্ধ বিরতিসহ তাঁর অন্য উদ্যোগসমূহকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন জাতিসংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের সকল দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, তেমনই এই মহামারী আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।
সব দেশ যেন সময় মতো একসঙ্গে করোনা ভ্যাকসিন পায় ॥ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে বলেন, আশা করা হচ্ছে বিশ্ব শীঘ্রই কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পাবে। এই ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সকল দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন সময় মতো এবং একইসঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও মেধাস্বত্ব প্রদান করা হলে, এই ভ্যাকসিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
তিনি বলেন, মহামারী নিরসনে আমাদের উদ্যোগ এবং এজেন্ডা-২০৩০ অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টা সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ রিপোর্ট উপস্থাপন প্রমাণ করে যে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে আমরা যথাযথভাবে এগিয়ে চলেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ এবং ২১০০ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ব-দ্বীপে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তিগত বিভাজন নিরসন, সম্পদ আহরণ ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য আমাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বল্পোন্নত হতে উন্নয়নশীল এবং সদ্য উত্তরিত উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এই আপদকালীন, উত্তরণকাল ও উত্তরণ পরবর্তী সময়ে বর্ধিত আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং প্রণোদনা প্যাকেজ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান তাঁর ভাষণে আরও বলেন, কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে, আমাদের সকলের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি। এই ভাইরাস আমাদের অনেকটাই ঘরবন্দী করে ফেলেছিল। যার ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকা-ও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের এই অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করেছে।
করোনা মোকাবেলায় তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আমরা প্রথম থেকেই ‘জীবন ও জীবিকা’ দুই ক্ষেত্রেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন যাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, তার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছি। আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছি। তিনি বলেন, দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমরা প্রতি বছর প্রায় ৩৯ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করি। এ ছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীসহ অন্যদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী ও ভাতার প্রচলন করেছি। যার মাধ্যমে প্রায় ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন পরিবার উপকৃত হচ্ছেন।
করোনা মোকাবেলায় ৩১ দফা নির্দেশনা ও ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ॥ প্রাণঘাতী করোনা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে তাঁর সরকারের ঘোষিত ৩১ দফা নির্দেশনা এবং ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার বিষয়টি বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ বিস্তারের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য আমরা তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে ১০ মিলিয়নের বেশি পরিবার উপকৃত হয়েছেন। আমরা ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করেছি। করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুরসহ ৫ মিলিয়ন মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছি। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হতে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়।
তিনি বলেন, সরকারী সহায়তার পাশাপাশি আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে তহবিল সংগ্রহ করে এতিম ও গরিব শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, স্কুল শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ যারা সাধারণভাবে সরকারী সহায়তার আওতাভুক্ত নন, তাদের মধ্যে ২ দশমিক ৫ বিলিয়নের বেশি টাকা বিতরণ করি। যার ফলে সাধারণ মানুষকে করোনাভাইরাস খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ৩১ দফা নির্দেশনা জারি করেছিলাম। করোনাভাইরাস যাতে ব্যাপকহারে সংক্রমিত হতে না পারে, তার জন্য আমরা সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর পাশাপাশি সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেছি। যার সুফল হিসেবে আমরা লক্ষ্য করছি, ঋতু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়, এবার সেসব রোগ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।
আর্থিক খাতের আশু সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে তাঁর সরকারের ঘোষিত ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রফতানিমুখী শিল্প, শ্রমিকদের সুরক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল প্রদান, রফতানি বৃদ্ধিতে ঋণ প্রদান, কৃষি ও কৃষকদের সহায়তা, কর্মসৃজনের জন্য ঋণ প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ, পুনর্অর্থায়ন স্কিম এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বীমা চালুকরণ ইত্যাদি খাত প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা মোট ১৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা আমাদের মোট জিডিপির ৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
তিনি বলেন, আমরা করোনাকালে খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। সেই সঙ্গে পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের শিল্প কারখানা সচল রাখা এবং কৃষি ও শিল্পপণ্য যথাযথভাবে বাজারজাতকরণের বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। যার ফলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি এখনও তুলনামূলকভাবে অনেক ভাল আছে। তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী উৎপাদনে স্থবিরতা সত্ত্বেও আমাদের ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশাবাদী।
অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার আহ্বান ॥ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি সহমর্মিতার সঙ্গে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বিবেচনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অভিবাসী গ্রহণকারী দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রবাসী শ্রমিকগণ স্বাগতিক ও নিজ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে চলেছেন। এই মহামারীর কারণে অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অনেককে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা দেশে ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের প্রণোদনা বাবদ ৩৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি। তবে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি সহমর্মিতার সঙ্গে ও ন্যায়সঙ্গতভাবে বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অভিবাসী গ্রহণকারী দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বিদ্যমান সমস্যাসমূহ প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। এই সঙ্কটকালেও আমাদের বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আমফানের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সিভিএফ ও ভি-২০ গ্রুপ অব মিনিস্টারস অব ফাইন্যান্সের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু সমস্যা উত্তরণে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নে নেতৃত্ব প্রদান করবে। এ ছাড়াও গ্লাসগো কনফারেন্স অব পার্টিস (সিওপি)-এ গঠনমূলক ও কার্যকর ফল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।
তিনি বলেন, লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণে বেজিং ডিক্লারেশন এ্যান্ড প্লাটফর্ম অব এ্যাকশন কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এই ঘোষণার ২৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনকালে ঘোষণায় উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসমূহ বাস্তবায়নে আমাদের দৃঢ় সঙ্কল্প ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা লিঙ্গ বৈষম্য সামগ্রিকভাবে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ কমিয়ে এনেছি। আমাদের জাতীয় উন্নয়নের মূলে রয়েছে নারীদের অবদান। মহামারী মোকাবেলাসহ সকল কার্যক্রমে বাংলাদেশের নারীরা সামনে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আমরা শিশুদের উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। ইউনিসেফের এক্সিকিউটিভ বোর্ডের বর্তমান সভাপতি হিসেবে আমরা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছি। তাছাড়া, কোভিড সংক্রান্ত সমস্যা যাতে শিশুদের সামগ্রিক সমস্যায় পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।
সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ॥ সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এই নীতিবাক্য আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং শান্তির সংস্কৃতি বিনির্মাণে নিয়মিত অবদান রেখে চলেছে। তিনি বলেন, মহামারীকালে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়গুলোর মোকাবেলা করতে পারি।
তিনি বলেন, শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। সংঘাতপ্রবণ দেশসমূহে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও শান্তি বজায় রাখতে আমাদের শান্তিরক্ষীগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যতম দায়িত্ব। এ বছর আমরা ওমেন, পিচ এ্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্ডা-এর ২০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছি। এই এজেন্ডার অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে আমরা শান্তি ও নিরাপত্তায় নারীর ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, শান্তির প্রতি অবিচল থেকে আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি। মহামারীর ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতীয় উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও অপরিহার্য। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী বিনির্মাণে বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার প্রতি আমাদের সমর্থন অবিচল। সে বিবেচনা থেকে পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহের কার্যক্রমকে আমরা জোর সমর্থন জানাই।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি তাঁর দেশের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙালী জাতি অবর্ণনীয় দুর্দশা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে। সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা নিপীড়িত ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছি।
বিশ্বের কাছে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার ॥ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমরা আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সে সোনার বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত- সেখানে সব মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে জাতি ও বিশ্বের কাছে এটিই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তাঁরই দেখানো পথে হেঁটে আমরা আজ বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল আসনে নিয়ে আসতে পেরেছি। এই মহান পরিষদে (জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ) দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ সনদে যে মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের জনগণের আদর্শ এবং এই আদর্শের জন্য তাঁরা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনে বাঙালী জাতি উৎসর্গকৃত, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এই দৃপ্ত ঘোষণা ছিল মূলত বহুপাক্ষিকতাবাদেরই বহির্প্রকাশ। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে তাঁর প্রদত্ত দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলার জন্য আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, বাঙালী জাতির জন্য এ বছরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ বছর আমরা আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্করছি। বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং সাফল্য আমাদের কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেমন সাহস জোগায়, তেমনই সঙ্কটের উত্তরণ ঘটিয়ে নতুন দিনের আশার সঞ্চার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে সকল বঞ্চিত ও উন্নয়নকামী দেশ ও মানুষের পক্ষ হতে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
বিশ্ববাসীর সামনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে জাতির পিতাকে নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা তুলে ধরে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের শিকার আমার পিতা এবং বাঙালী জাতির পিতা, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার মা, আমার তিন ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমরা দুই বোন দেশের বাইরে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। শরণার্থী হিসেবে আমাদের ৬ বছর দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। আমি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি এ জন্য যে, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম জঘন্য, নির্মম ও বেআইনী হত্যাকা- যেন আর না ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শেষাংশে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিদ্যমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ আরও প্রকট হয়েছে। এ মহামারী আমাদের উপলদ্ধি করতে বাধ্য করেছে যে, এ সঙ্কট উত্তরণে বহুপাক্ষিকতাবাদের বিকল্প নেই। জাতিসংঘের ৭৫তম বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ সনদে অন্তর্নিহিত বহুপাক্ষিকতাবাদের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও বহুপাক্ষিকতাবাদের আদর্শ সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।
