ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীদের হাতে চলে যাচ্ছে বিস্ফোরক

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

জঙ্গীদের হাতে চলে যাচ্ছে বিস্ফোরক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিস্ফোরক চলে যাচ্ছে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের হাতে। লাইসেন্সধারী অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকায় বিস্ফোরক কিনে নিচ্ছে জঙ্গীরা। আর এসব বিস্ফোরক ব্যবহৃত হচ্ছে নাশকতায়। ব্যবসায়ী ছাড়াও কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও অবৈধ অস্ত্রগোলাবারুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক যোগাড়ের বিষয়টি তদন্তে ধরা পড়েছে। দেশে তালিকাভুক্ত ৫৯ বিস্ফোরক ব্যবসায়ীর অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বেআইনীভাবে ভুয়া ভাউচারে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক বিক্রির অভিযোগ আছে। নিয়মিত মনিটরিং করার কথা থাকলেও তা শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে না। তবে নতুন করে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা যাতে বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে না পারে, এজন্য সরকারের তরফ থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নিয়মিত বিস্ফোরকের আমদানি ও বিক্রির ফিরিস্তি জমা দিতে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ঢাকা থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা, ককটেল ও হ্যান্ডগ্রেনেড। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতীয় জঙ্গীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরকে তৈরি করা হয় শক্তিশালী বিস্ফোরক। যা বড় ধরনের নাশকতায় ব্যবহার করা হয়। গত উনিশ বছরে অস্ত্রগোলাবারুদের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় বিশ হাজার ব্যক্তি। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ, বিস্ফোরক পরিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১ থেকে হালনাগাদ প্রায় উনিশ বছরে প্রায় পঁচিশ হাজার অস্ত্রগোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় দশ হাজার। গ্রেফতার হয়েছে প্রায় বিশ হাজার ব্যক্তি। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলারুদের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার কেজি বিভিন্ন প্রকারের বিস্ফোরক ও ৩৩৪টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রায় প্রতিদিনই অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটলেও ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও বোস্টন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে সোয়া ৫ কেজি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ পুলিশের হাতে এইচএম আতিকুর রহমান (২৪) ও মাহবুবুর রহমান (১৮) নামের দু’জনের গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। কারণ গ্রেফতারকৃত আতিকুর রহমান পেশায় শিক্ষক। অপরজন আতিকুর রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন এডুকেয়ার কোচিং একাডেমির অফিস সহকারী। পরবর্তীতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, দুইজনই বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তারা কোচিং সেন্টারের আড়ালে বিস্ফোরক মজুদের কাজ করত। ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলত। বিস্ফোরকের চালানটি তারা শিবিরের এক নেতার কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে বিস্ফোরকগুলো পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষায় সেগুলো উচ্চমাত্রার বলে মতামত দেয় বিস্ফোরক পরিদফতর। বিস্ফোরক পরিদফতরের ভাষ্য মোতাবেক, উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা ও গ্রেনেড তৈরি সম্ভব ছিল। এ ধরনের বিস্ফোরকের তৈরি বোমা একই জায়গায় দুই থেকে তিনটির একত্রে বিস্ফোরণ ঘটালে কমপক্ষে দশজনের মৃত্যু হবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গী সংগঠনের সদস্য বলে স্বীকারও করে। ওই ঘটনার সূত্র ধরে ডিবি পুলিশের অভিযানে ঢাকা মহানগর যুবদল নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটুর যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগের বাড়ি থেকে দুই দফায় ৯৭টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার হয়। ওই সময় গ্রেফতার হওয়া বাড়ির কেয়ারটেকার বেলায়েত হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে জানায়, বোমাগুলো দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা তৈরি করে নাশকতা চালানোর জন্য ওই বাড়িতে মজুদ করেছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে ঢাকার বনানী ছাত্র শিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা, গান পাউডার, জিহাদী বই ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের তালিকা উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয় ছাত্র শিবিরের বনানী থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ পাঁচজন। বিস্ফোরক পরিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, মূলত এসব ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের বিস্ফোরক সংগ্রহ সংক্রান্ত নানা তথ্য। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক, অধিকাংশ বিস্ফোরক ঢাকা ও সীমান্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। শুধু ঢাকায় বৈধ বিস্ফোরক দ্রব্য বিক্রির দোকানের সংখ্যা ৫৯টি। এসব দোকানের অধিকাংশই বংশাল, সুরিটোলা, করাতিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, টিকাটুলী ও মিটফোর্ডসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। এসব দোকানে যে ধরনের বিস্ফোরক আমদানি ও বিক্রির অনুমতি দিয়ে থাকে জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন। নিয়মানুযায়ী দোকানগুলো কি পরিমাণ বিস্ফোরক আমদানি করে এবং বিক্রি করে তা মনিটরিং করার কথা। প্রতিমাসেই নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত পরিদর্শকের কাছে বিস্ফোরক দোকানগুলো মনিটরিং করার কথা। সরকারী হিসেবে অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা কি কি ধরনের কী পরিমাণ বিস্ফোরক আমদানি করেছে তার হিসেব দেয়ার কথা। আর কি কি ধরনের কী পরিমাণ বিস্ফোরক কোন কোম্পানির কাছে কী উদ্দেশ্যে বিক্রি করেছে তার ফিরিস্তি সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেয়ার কথা। বিক্রির পর বাড়তি থাকা বিস্ফোরক সম্পর্কেও বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও পরিদর্শকের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। এ কাজ শুধু কাগজে কলমে রয়েছে। বাস্তবে এর কোন বালাই নেই। বিস্ফোরক ব্যবসায়ী সমিতিও এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। তারা বিস্ফোরক বিক্রির পুরো হিসেব সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেয় বলে দাবি করে। বাস্তবে বিস্ফোরক বিক্রির প্রকৃত কোন হিসেব তারা জমা দেয় না। এসব বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক উপসচিব মোঃ মঞ্জুরুল হাফিজ জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকাংশ বিস্ফোরকই সরকারীভাবে আমদানি করা হয়। তবে দিয়াশলাই (ম্যাচ) ফ্যাক্টরিতে কাজে লাগে এমন বিস্ফোরকের আমদানির অনুমতি তারা দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি তারা মনিটরিং করেন। নিয়মানুযায়ী ম্যাচ ফ্যাক্টরিগুলো কি পরিমাণ বিস্ফোরক আমদানি করবে বা করেছে, ব্যবহৃত রেড সালফারের পরিমাণ কত এবং বাড়তি থাকা রেড সালফার সম্পর্কে বিস্ফোরক পরিদফতরকে অবহিত করার কথা। আমরাও নিয়মিত বিষয়গুলো মনিটরিং করি। এছাড়া বড় পুকুরিয়া কয়লাখনি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী সরকারীসহ অন্যান্য কোম্পানি, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিসহ বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহৃত বিস্ফোরক সরকারীভাবে আমদানি করা হয়ে থাকে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ম্যাচ তৈরি করতে যে রেড সালফার ব্যবহৃত হয়, তা ককটেল বা হাতবোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হয়। ভুয়া বাউচারে অসাধু বিস্কোরক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জঙ্গী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিস্ফোরক বিক্রি করে থাকে। আবার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও মোটা টাকা দিয়ে বিস্ফোরক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবং তাদের মাধ্যমে বিস্ফোরক আমদানি করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ম্যাচ ফ্যাক্টরির মাধ্যমেও এসব বিস্ফোরক যোগাড় করে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, মূলত জঙ্গীদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে বিস্ফোরক সংগ্রহের তথ্য। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরী, বিস্ফোরকের দোকান ও ম্যাচ ফ্যাক্টরি থেকে যোগাড় করা কয়েক ধরনের বিস্ফোরকের সমন্বয়ে তারা শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি করে। ইতোপূর্বে বিচ্ছিন্ন হামলা এবং পুলিশের উপর হামলায় তারা ওইসব বিস্ফোরকের তৈরি শক্তিশালী বোমাই ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নানাভাবে বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে পারে। বিশেষ করে অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও ম্যাচ ফ্যাক্টরির সঙ্গে যোগসূত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা বিস্ফোরক সংগ্রহ করে বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এসব অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও ম্যাচ ফ্যাক্টরির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। বিস্ফোরক বিক্রির উপর নজরদারি অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার প্রকৌশলী মো ওয়ালিদ হোসেনও।
×