ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিস্ফোরণের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিস্ফোরণের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শীতের আগেই গ্যাস সিলিন্ডার, কম্প্রেসার, বয়লার ও সেপটিক ট্যাঙ্ক ব্যবহার এবং পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা জারি করেছে বিস্ফোরক পরিদফতর। কারণ শীতের ভয়ে অধিকাংশ মানুষই তাদের বাসা বাড়ির দরজা জানালা খোলেন না। দীর্ঘ সময় আবদ্ধ থাকার কারণে বিশেষ করে গ্যাস সিলিন্ডার, এসি, ফ্রিজ, গাড়ি, পেট্রোলপাম্প ছাড়াও নানা ধরনের কম্প্রেসার, বয়লার ও সেপটিক ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শীতের কারণে সব কিছু শুষ্ক থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি তুলনামূলক অনেক বেশি। শীতের সময় সবকিছু শুষ্ক থাকায় বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকা- ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রতি বছর গ্যাস সিলিন্ডার, কম্প্রেসার, বয়লার ও সেপটিক ট্যাঙ্কসহ অন্যান্য বিস্ফোরণে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের মৃত্যু হয়। দগ্ধ হয় গড়ে চার থেকে পাঁচ শ’ জন। যার অধিকাংশই ঘটে শীত মৌসুমে। শীতের সময় যাতে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, এজন্য সরকারের তরফ থেকে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জারির নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। বিস্ফোরক পরিদফতর সূত্র বলছে, গাজীপুরের ট্যাম্পাকো গার্মেন্টসের মেয়াদোত্তীর্ণ ব্রয়লার বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে, পল্লবীতে বেলুন ফুলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশুর মৃত্যু এবং সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল ব্যাপক আলোচিত। এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করে দেখা হয়েছে। তদন্ত দেখা গেছে, বছরে গড়ে ৫ থেকে ৬টি বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ছোটখাটো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। বিস্ফোরণে বছরে গড়ে মারা যান অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন। আর দগ্ধ হন চার থেকে পাঁচ শ’ জন। দগ্ধদের অধিকাংশই পরবতীতে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মারা যান। আর যারা বেঁচে থাকেন, তারা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসা করাতে করাতে অধিকাংশ পরিবার পথে বসার নজির আছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এর অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে সচেতনতার অভাবে। আর এসব দুর্ঘটনা ঘটে নিয়ম না মেনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের পর গ্যাসের লাইন বন্ধ করে না রাখা, ঘরের দরজা জানালা লাগিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার বা গ্যাসের লাইনে রান্না বান্না করা, গ্যাস লাইনের লিকেজ, গাড়ির মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময়, মেয়াদোত্তীর্ণ পেট্রোলপাম্পে কম্প্রেসার বিস্ফোরণ, সার্ভিসিং না করার কারণে এসির কম্প্রেসার বিস্ফোরণ, সেপটিক ট্যাঙ্কে জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণের ফলে। অথচ রান্না করার আগে ঘরের দরজা জানালা খুলে কয়েক মিনিট পরে রান্না শুরু করলে ঘরে গ্যাস জমে থাকার ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই। স্বাভাবিক কারণে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাই থাকে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মোঃ মঞ্জুরুল হাফিজ জনকণ্ঠকে জানান, শুধু সচেতনতার অভাবে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। অনেকেই অলসতার কারণে বা টাকার কারণে বা ঝামেলা মনে করে বাসার এসি সার্ভিসিং করান না। যা খুবই বিপজ্জনক। একই অবস্থা বাসা বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। মনের ভুলে গ্যাসের চুলা বা সিলিন্ডার চাবি অন করে রেখে দেন। আবার শীতের ভয়ে ঘরের দরজা জানালা খোলেন না। এতে বাসা বাড়িতে গ্যাস জমে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই কর্মকর্তা বলছেন, মানুষের আয় বাড়ছে। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিলাসী জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এটিই স্বাভাবিক। বিলাসী জীবন যাপনের অন্যতম উপকরণের অধিকাংশ বৈদ্যুতিক। যার মধ্যে আছে গাড়ি, এসি, ফ্রিজ, ওভেনসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী। ফলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা থেকেই যায়। অনেকেই মোটামুটি সামর্থ্য হওয়ার পরেই পুরনো গাড়ি কিনে থাকেন। এসব পুরনো গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে এসির কম্প্রেসার স্বাভাবিক কারণেই পুরনো। এসব পরিবর্তন করার প্রয়োজন না মনে করেই চালানো শুরু করেন। ফলে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে। আবার গ্যাস পাম্পে থাকা সিলিন্ডারগুলোও সময়মতো পরিবর্তন করে না। ফলে প্রায়ই পেট্রোলপাম্পে দুর্ঘটনা ঘটে। পেট্রোলপাম্পগুলোও যথাযথ নিয়ম মানে না। পাম্পে গ্যাস নেয়ার সময় চালক থেকে শুরু করে যাত্রী সবারই গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করার কথা। গরমের সময় যাও কিছুটা হয়, শীতের সময় চালক ব্যতীত কোন যাত্রীর গাড়ি থেকে নামার নজির খুবই কম। যাত্রীদের ভাষ্য, কিছুই হবে না। বাইরে শীত করে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। আর সেপটিক ট্যাঙ্কের ঢাকনা খোলার পর নিয়মানুযায়ী ট্যাঙ্কের ভেতরে ১৫ থেকে ২০ মিনিটি টেবিল ফ্যান দিয়ে বাতাস দেয়ার নিয়ম। এতে করে ভেতরে জমে থাকা গ্যাস সরে যায়। অক্সিজেনসহ বাতাস সেখানে প্রবেশ করে। এত কিছু না করে শুধু যদি সেপটিক ট্যাঙ্কের ঢাকা খুলে আধা ঘণ্টা রেখে দেয়া যায়, তাহলেও ভেতরের গ্যাস চলে যায়। এরপর কাজ করলে অক্সিজেনের অভাবে কারও যেমন মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তেমনি বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটবে না। অনেকেই তাড়াহুড়া করে ঢাকনা খোলার পর কাজ করতে গিয়েই বিপত্তির সৃষ্টি করেন। এছাড়া প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী কোম্পানিকে সিলিন্ডারের গায়ে কি কি লেখা থাকা বাধ্যতামূলক সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ খোদাই করে বা অমোচনীয় কালি দিয়ে স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। সিলিন্ডারের গ্যাস কিভাবে রান্না বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা বাংলায় লেখা থাকতে হবে। ব্যবহারের পর সিলিন্ডার কিভাবে রাখতে হবে, সিলিন্ডার থেকে গ্যাসের চুলার দূরত্ব কত হবে, সে সম্পর্কেও নির্দেশনা আছে। অনেক সিলিন্ডার ব্যবহারকারী তা মানেন। আবার অনেকেই মানেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এই কর্মকর্তা বলছেন, ফিলিং স্টেশনে থাকা নিম্নমানের কম্প্রেসার বা মেয়াদোত্তীর্ণ কম্প্রেসার বা গ্যাস সিলিন্ডার এবং গাড়িতে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ বা নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এ ধরনের বিস্ফোরণে সাধারণত ফিলিং স্টেশনের কর্মকর্তা কর্মচারী, গাড়ির চালক এমনকি যাত্রীদেরও মারা যাওয়ার রেকর্ড বেশি। কারণ যাত্রীরা অলসতা করে গাড়ি থেকে নামেন না। আর কলকারখানার বয়লার দেখভালের মূল কাজটির দায়িত্ব মূলত শ্রম মন্ত্রণালয়ের। তবে কোন কল কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে বিস্ফোরক পরিদফতরের কলকারখানা পরিদর্শন বিভাগও তার তদন্ত করে। তদন্তে দেখা যায়, অধিকাংশ কারখানার মালিকই বিস্ফোরক পরিদফতর বা শ্রম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মানেন না। বার বার তাগাদা দেয়ার পরেও তারা মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার পরিবর্তন করেন না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিয়ম কানুন মেনে চললে এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে বিস্ফোরণের মাত্রা কমে আসতে বাধ্য। এজন্য শীত আসার আগেই আগাম নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনা মানাতে মাঠ পর্যায়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনুরোধ করা হয়েছে। মনিটরিং ব্যবস্থা ভাল হলে বিস্ফোরণের ঘটনা যেমন কমবে, তেমনি স্বাভাবিকভাবেই কমবে হতাহতের সংখ্যা।
×