ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এটিএম জালিয়াতি কমেছে

প্রকাশিত: ২২:২৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

এটিএম জালিয়াতি কমেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনার পরও বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতে এন্টি স্কিমিং ভিভাইস বসানোর কাজ শতভাগ কার্যকর হয়নি। যে কারণে দীর্ঘ চার বছরেও এটিএম বুথ থেকে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়া থেমে নেই। এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস না থাকার সুযোগ নিচ্ছে দেশী-বিদেশী চক্র। তারা এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যাদের অধিকাংশই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা কারণে এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে ঘটনা কমে এসেছে। আগামীতে এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে নানামুখী প্রযুক্তিগত তৎপরতা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সিআইডি পুলিশ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে এটিএম বুথ থেকে পুরনো প্রযুক্তির কম্পিউটার সরিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটার স্থাপন, বিটিআরসির মাধ্যমে রেজিস্টার্ড ইন্টারনেট কোম্পানির মাধ্যমে এটিএম বুথে সংযোগ স্থাপন করা। লোকাল ইন্টারনেট কোম্পানির মাধ্যমে এটিএম বুথে সংযোগ স্থাপন না করা। সিআইডি পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং শাখা ও সাইবার ইউনিট সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে। তারা বলছে, গত চার বছরে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিশেষ করে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে একশ’ ২০ জনের মতো গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে ৭০ জনেরও বেশি বিদেশী। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক, এটিএম বুথে টাকা তোলার ছল করে বা নিরাপত্তা প্রহরীদের হাত করে তারা বিশেষ ডিভাইস লাগিয়ে আসে। গ্রাহক টাকা তোলার সময় সেই ডিভাইস বা ক্যামেরায় গ্রাহকের গোপন পিন নম্বরের তথ্য রয়ে যায়। আবার পজ মেশিন থেকেও এভাবেই গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে সেই তথ্য দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে। আর সেই কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিটি এটিএম বুথে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তবে এসব ক্যামেরা মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। অনেক এটিএম বুথের সিসি ক্যামেরা নষ্ট বা অকেজো থাকার ঘটনাটিও ইতোমধ্যেই তদন্তে ধরা পড়েছে। আবার নিয়মানুযায়ী এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সময় মাথায় হেলমেট বা মুখ ঢেকে না রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনেকেই মুখ ঢেকে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলছে। আবার এটিএম বুথের নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে যোগসাজশেও এমন ঘটনা ঘটছে। যা এটিএম বুথের টাকাকে অনিরাপদ করে তুলছে। এখনই যদি ব্যাংকগুলো এসব বিষয়ে সতর্ক না হয়, তাহলে প্রতারক চক্র সুযোগ নিতে পারে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংককে সিআইডি পুলিশের তরফ এসব বিষয় অবহিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অন্য ব্যাংকগুলোকে এসব বিষয়ে সতর্ক করেছে। এ ব্যাপারে সিআইডি পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা বেশ কিছু সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছি। আরও কিছু সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। মূলত এটিএম বুথ থেকে ক্লোন কার্ডের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে বন্ধ করতে ডিজিটাল ও ম্যানুয়ার দুই ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেখা গেছে, অনেক ব্যাংকের এটিএম বুথের কম্পিউটার অনেক পুরনো মডেলের। বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ কম্পিউটার পাওয়া যায়। পুরনো কম্পিউটার পরিবর্তন করা জরুরী। অন্যথায় হ্যাকার বা প্রতারক চক্র তার সুযোগ নিতে পারে। অধিকাংশ ব্যাংক লোকাল ইন্টারনেট কোম্পানির কাছ থেকে সংযোগ নিয়ে এটিএম বুথ চালাচ্ছে। যা একেবারেই অনিরাপদ। মূলত টাকা সাশ্রয় করতে অধিকাংশ ব্যাংক এমন সংযোগ নিয়েছে। যা একেবারেই অনিরাপদ। লোকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখা গেছে তারা ৫ থেকে ৬টি এটিএম বুথের সঙ্গে লিংক করে দিচ্ছে। যেটি মুটেই নিরাপদ না। এজন্য বিটিআরসির সঙ্গে কথা বলছি। সব এটিএম বুথ যদি সরকারী বা সরকারী অনুমোদিত রেজিস্টার্ড ইন্টারনেট কোম্পানি থেকে সংযোগ নেয়, তাহলে ঝুঁকি কমে আসবে। কারণ ওইসব কোম্পানি জবাবদিহিতার আওতার মধ্যে থাকবে। যদিও এজন্য ব্যাংকগুলোর একটু বাড়তি খরচ পড়বে। তারপরেও এটিএম বুথ সুরক্ষিত থাকবে। ব্যাংকগুলোকে হয়তো আর জরিমানা গুনতে হবে না। এর বাইরে ব্যাংকের সকল এটিএম বুথ যদিও একই ইন্টারনেটের মধ্যে আনা সম্ভব হয়, তাহলে মনিটরিং করা আরও সহজ হবে। পাশাপাশি এটিএম বুথে থাকা নিরাপত্তা প্রহরীদের আরও সতর্ক করতে হবে। এসব বিষয়ে সহসাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে উর্ধতন পর্যায়ে বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে। সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলছেন, গত চার বছরে এভাবেই দেশের অন্তত এক হাজার এটিএম বুথ থেকে সরকারী তথ্য মোতাবেক দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রগুলো। যদিও বাস্তবে হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ আরও বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে থাকা আন্তর্জাতিক এটিএম বুথ জালিয়াতি চক্রের সন্ধান অব্যাহত রেখেছে। হালনাগাদ বাংলাদেশে এটিএম বুথ জালিয়াতিতে গ্রেফতার হওয়া দেশী-বিদেশী সদস্যদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে সিআইডি ও আন্তর্জাতিক এটিএম বুথ মনিটরিং টিমের সদস্য হিসেবে থাকা বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের তথ্য মোতাবেক, প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রথম ধরা পড়ে ২০১৬ সালে। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অন্তত ২১ জন গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনার দুই দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় একই ধরনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, প্রতারক চক্র নিজেও ব্যাংকের লোক পরিচয়ে ব্যাংকটির বিভিন্ন এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া পল্লবী থানায় সিটি ব্যাংকের তরফ থেকে এমন অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্কিমিং ডিভাইসটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪০টি কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। বাকি ১১শ’৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। মামলাগুলোর তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, তদন্তের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানির নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক (৫০), সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) ও রেফাত আহমেদ রনিকে (৪২) গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মতে, চক্রটি শুধু বাংলাদেশেই সক্রিয় নয়। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সক্রিয়। তারা শুধু ২০১৬ সালেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যার মধ্যে ২০১৬ সালেই চক্রটি বাংলাদেশ থেকে অন্তত একশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করেছে। পুরো জালিয়াতি চক্রটির সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী পলাতক দুই বাংলাদেশী ছাড়াও চার বিদেশী জড়িত। পলাতকদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। পলাতক বিদেশীরা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। আর গ্রেফতারকৃত বিদেশী পিওটর বিশ্বের ৪টি দেশে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে তালিকাভুক্ত। পিওটর মূলত জার্মানির নাগরিক। তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক পরিচয়ে প্রতারণার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। মনিরুল ইসলাম জানান, দেশের প্রায় সব ব্যাংকের এমটিএম সেবা চালু আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংককে যার যার এটিএম বুথে স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় এবং প্রযুক্তিতে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসানোর লিখিত নির্দেশ দিয়েছে। তারপরও অধিকাংশ এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় দেশী-বিদেশী চক্রগুলো। তারা কার্ড প্রবেশ করানোর জায়গায় এবং এটিএম বুথের মনিটরের উপরের দিকে সূক্ষ্ম ক্যামেরা বসিয়ে রাখে। সেই ক্যামেরায় ভিডিও হয় গ্রাহকের গোপন পিন নম্বর। সেই পিন নম্বর দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৭ সালের ১০ মার্চ র‌্যাব-১০ এর হাতে আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ১১ জন গ্রেফতার হয়। চক্রের হোতা সোহেল। তিনি দুবাই থাকার সময় এরিক লিমো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মাধ্যমে এটিএম কার্ড জালিয়াতির কৌশল শিখে। সেই বিদেশীই তাকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। এরিক লিমো ১২ বছর ধরে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। দুবাইতে ৫ বছর সোহেল এরিক লিমোর সঙ্গে কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি হাতিয়ে নেয়। সোহেল ও পিটার নামের এক বিদেশী ২০১৭ সালে বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে পিটার গ্রেফতার হয়। চক্রটির সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতি চক্রের যোগাযোগ আছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের এপ্রিলে হাতঘড়ির বিশেষ ডিভাইসে এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে সেই তথ্য দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার সঙ্গে জড়িত শরিফুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় বিভিন্ন ব্যাংকের ১৪শ’ ক্লোন এটিএম কার্ড, একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড রিডার ও রাইটার, তিনটি পজ মেশিন, তথ্য চুরির কাজে ব্যবহৃত ডিজিটাল হাতঘড়ি, দুটি মিনি কার্ড রিডার ডিভাইস, ১৪টি পাসপোর্ট, আটটি মোবাইল ফোনসেট, ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের একটি নেক্সাস ক্রেডিট কার্ড, তিনটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও একটি পরচুলাসহ নানা সরঞ্জাম। শরিফুল শুধু ২০১৮ সালের শুরুতেই ব্র্যাক, সিটি, ইবিএল, ইউসিবিএল ও ব্যাংক এশিয়ার এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শরিফুল বিভিন্ন চেইন শপে পজ মেশিন দিত। সেই মেশিনে বিশেষ ডিভাইস বসিয়ে দিত। গ্রাহকরা পজ মেশিনে ব্যাংকের এটিএম কার্ড পাঞ্চ করলে কার্ডের তথ্য থেকে যেত সেই ডিভাইসে। এভাবে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করত। আর সেই কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিত। শরীফুল ইসলাম ডিপার্টমেন্টাল শপ স্বপ্নের বনানী শাখায় কাজ করত। সুবিধার জন্য বাম বা ডানহাতে বিশেষ ডিভাইসযুক্ত হাতঘড়িটি পরত। গ্রাহক যখন তার এটিএম কার্ডটি পজ মেশিনে দিতো, তখন যেকোন কাজের উছিলায় তার হাতঘড়িটি পজ মেশিনের সঙ্গে স্পর্শ করাত। এতে করে সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের যাবতীয় তথ্য ব্লু টুথের মাধ্যমে হাতঘটিতে থাকা মিনি কার্ড রিডার ও স্ক্যানারে জমা হতো। বাসায় তার ল্যাপটপ ও ডিভাইসের মাধ্যমে কাস্টমারের তথ্যগুলো দিয়ে ভার্জিন কার্ড বা খালি কার্ডে স্থাপন করে ক্লোন এটিএম কার্ড বানাত। পরে সুবিধাজনক এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিত। বুথে টাকা তোলার সময় সিসি ক্যামেরায় যাতে তার আসল চেহারা না ওঠে, এজন্য সে কালো বিশেষ ধরনের সানগ্লাস ও পরচুলা ব্যবহার করত। অন্য চেহারা ধারণ করে এটিমে বুথ থেকে টাকা তুলে নিতো। স্বপ্ন নামের সুপার শপটিতে চাকরি করলেও তার মূল পেশা ছিল এটিএম কার্ড জালিয়াতি করা। জালিয়াতির মাধ্যমে সে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জালিয়াতির টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করত। একটি সুপার শপের কর্মচারী হয়েও সে ব্যক্তিগত চলাচলের জন্য টয়োটা এলিয়ন মডেলের গাড়ি ব্যবহার করতো। তার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। পরে ওইসব এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। শরিফুল রাশিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় তার রাশিয়ান রুমমেট ইভানোভিচের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার কৌশল শিখে। দেশে আসার পরপরই সে কার্ড জালিয়াতি শুরু করে। ২০১৩ সালে এ সংক্রান্ত দুটি মামলা হয়। ওই মামলা দুটিতে শরিফুলের ১৮ মাসের সাজা হয়েছিল। তখন ঘটনাটি ততটা আলোড়ন তুলতে পারেনি। ২০১৬ সালে এটিএম কার্ড জালিয়াতির বিষয়টি ব্যাপকহারে প্রকাশ্যে চলে আসে। তার আগেই ২০১৪ সালের শেষ দিকে জামিনে বেরিয়ে সে আবারও প্রতারণার কাজে নেমে পড়ে। এছাড়া গত বছরের ১ জুন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের খিলগাঁওয়ের এটিএম বুথ থেকে কার্ড জালিয়াতি করে ৩ লাখ টাকা উত্তোলনের ঘটনায় ইউক্রেনের সাত নাগরিক দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), আলেগ শেভচুক (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কিকে (৩৭) ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম নামের এক দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকের সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ডেমরার সারুলিয়া ও ডেমরা শাখার এ্যাকাউন্টে থাকা টাকার মধ্যে ১৩ লাখ বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে গত বছরের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত সে টাকাগুলো ব্যাংকটির বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে গত বছরের ৬ নবেম্বর রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সাইবার ইউনট, সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ ও সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, এটিএম কার্ডের মাধ্যমে অর্থ জালিয়াতির ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হচ্ছে। এমন অপরাধের আদ্যোপান্ত জানতে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক টিম গঠিত হয়েছে। যেসব দেশে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, সেইসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রতারণা। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে নিজের নাম ঠিকানা ভুল দিয়ে প্রবেশ করে এমন অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে।
×