ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাকিল আহমেদ মিরাজ

ছোট ক্রলির বড় ইনিংস

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৬ আগস্ট ২০২০

ছোট ক্রলির বড় ইনিংস

সাউদাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারনী টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২৬৭ রানের অনবদ্য এক ইনিংস উপহার দিয়েছেন জ্যাক ক্রলি। টেস্ট ক্রিকেটের অনেক পরিসংখ্যানই নাড়িয়ে দিয়েছেন কেন্ট থেকে উঠে আসা তরুণ এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ডের তৃতীয় কনিষ্ঠতম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরিয়ান তিনি। ক্রলি ডাবল সেঞ্চুরি করেন ২২ বছর ২০১ দিন বয়সে। প্রায় ১৪০ বছরের ইতিহাসে ইংলিশদের হয়ে তার চেয়ে কম বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন মাত্র দুজন- কিংবদন্তি লেন হাটন (২২ বছর ৫৮ দিন) ও ডেভিড গাওয়ার ( ২২ বছর ১০২ দিন)। ক্রিকেট রেকর্ডের খেলা। এর বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকে রেকর্ড। টেড ডেক্সটার, এ্যালিস্টার কুক, বর্তমান অধিনায়ক জো রুটের পর চতুর্থ ইংলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি পেয়েছেন ক্রলি। তার আরেকটি কীর্তি, ইংল্যান্ডের সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকে ডাবল সেঞ্চরিতে রূপ দিয়েছেন। পঞ্চম উইকেটে জুটির রেকর্ডগড়া সঙ্গী জস বাটলার থেকে শুরু করে গ্রেট সৌরভ গাঙ্গুলী-বিশ্বজুড়ে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন ক্রলি। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটিকে ডাবলের দিকে নিয়ে ছুটে ১৫২ রানে আউট হয়েছেন ক্রলির সঙ্গী বাটলার। নিজের টেস্ট সর্বোচ্চ রান করে ফিরতি ক্যাচ দিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার ফাওয়াদ আলমকে। তার আগেই অবশ্য রেকর্ড হয়ে গেছে। ক্রলি-বাটলার মিলে স্বাগতিকদের স্কোরবোর্ডে যোগ করেন ৩৫৯ রান। দু’জনের হাত ধরে পঞ্চম উইকেটে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম তিন শ’ রানের জুটি পায় ইংল্যান্ড। যেখানে আগের সর্বোচ্চ ছিল ২৫৪ রানের। ১৯৭৩ সালে মুম্বাইয়ে ভারতের বিপক্ষে কিথ ফ্লেচার ও টনি গ্রেগ গড়েছিলেন সেই জুটি। সর্বোপরি টেস্ট ইতিহাসে পঞ্চম উইকেট জুটিতে পঞ্চম স্থানে থেকে ভাগ বসিয়েছেন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে। দুই টাইগার তারকা ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে বেসিন রিজার্ভে ঠিক ৩৫৯ রান তুলেছিলেন। ক্রলি ও বাটলার মাত্র ১ রানের জন্য সাকিব-মুশফিককে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। টেস্ট ইতিহাসে পঞ্চম উইকেটে সর্বোচ্চ তিনটি জুটির রেকর্ড যথাক্রমে সিডনি বার্নস-ডন ব্র্যাডম্যান (৪০৫ রান, বনাম ইংল্যান্ড, সিডনি, ১৯৪৬), স্টিভ ওয়াহ-গ্রেগ ব্লুয়েট (৩৮৫ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ, ১৯৯৭), ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড় (৩৭৬ বনাম অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, ২০০১)। ৭৪টি প্রথম শ্রেনীর ইনিংসে ৩০.৮২ গড়ে রান মাত্র ২২৫০। এমন একজন ব্যাটসম্যানকে কেন তিন নম্বরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পজিশনের জন্য বেঁছে নেয়া হল? যেখানে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাসে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরিতে রানের বণ্যা বইয়ে দেয়া ক্রিকেটারের অভাব নেই। প্রথম ৭ টেস্টের ১১ ইনিংসে মাত্র ৩টি হাফ সেঞ্চুরির পরও কেন তাঁকে টেনে নেয়া? জ্যাক ক্রলিকে ঘিরে ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল নিন্দুকেদের স্লোগান। তখনই গাঁ ঝাড়া দিয়ে উঠলেন কেন্ট থেকে উঠে আসা ২২ বছর বয়সি এ ব্যাটসম্যান। সাউদাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারনী তৃতীয় ও শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে খেললেন ২৬৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। শাহিন শাহ আফ্রিদি, ইয়াসির শাহদের মতো বোলারকে তুলোধুনে করে আউট হলেন অকেশনাল আসাদ শফিকের সাদামাটা এক ডেলিভারিতে! এটাই যে ক্রিকেটের সৌন্দর্য!! নিজের অষ্টম টেস্টে এসে ক্যারিয়ারে পাওয়া প্রথম সেঞ্চুরিটিকে ডাবল সেঞ্চুরতে রূপ দিয়ে তখন ‘ট্রিপলে’র দিকে ছুটছেন ক্রলি। নিয়মিত বোলারদের তাকে আউট করা দূরে থাক জুটিটাই ভাঙতে পারছিলেন না আজহার আলী। শেষমেশ বল তুলে দিলেন অকেশনাল অফস্পিনার শফিকের হাতে। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার প্রবণতা দেখে বল শফিক করেছিলেন লেগ স্টাম্পের বাইরে, উইকেটকিপার রিজওয়ান স্টাম্পিং করতে কোনও ভুলচুক করেননি। আউট ২৬৭Ñ স্টাম্পিংয়ে থেমে যাওয়া টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংসটা এখন ক্রলির! আগের রেকর্ডটি ছিল সিমুর নাসেরের। ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চে ২৫৮ রানে স্টাম্পড হয়েছিলেন এই ক্যারিবিয়ান। আড়াই শ’ পেরিয়ে স্টাম্পড হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে টেস্টে আর কেবল একজনেরই। ২০০৩ সালের বক্সিং ডে টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ২৫৭ করে অনিল কুম্বলের বলে স্টাম্পড হয়েছিলেন রিকি পন্টিং। দলের ১২ রানে ওপেনার ররি বার্নস ফিরে গেলে উইকেটে আসেন ক্রলি। আর যখন আউট হন, ৩৯৩ বলে ৩৪ চার আর ১ ছক্কায় নামের পাশে ২৬৭ রান, ইংল্যান্ডের দশম সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত টেস্ট স্কোর, তিন নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বর্গীয় ওয়ালি হ্যামন্ডের অপরাজিত ৩৩৬ রানের পরে ইংল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ক্রলির মতো ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকে ডাবল বানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক ব্যাটসম্যান রব কি। তাকেই আদর্শ মানেন ক্রলি। ক্রলির বাবাও ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে খুব খেটেছেন। রব সেসবের সাক্ষী, ‘ক্রলিকে নেটে ছেড়ে দিয়েই তার বাবা দায়মুক্ত হতেন না। ঘরে ফিরে খেলার প্রতি ছেলের ভালোবাসা তৈরি করতেও সচেষ্ট থাকতেন। ক্রলিকে ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যা দরকার সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিলন তার বাবা। আমি অনেক ছেলের বাবাকেই দেখেছি। কিন্তু ক্রলির বাবার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।’ মাত্র ১৩ বছরে কেন্টে ভর্তি হয়েছিলেন ক্রলি। এরপর ছাত্রের মনে পরিশ্রম আর উপভোগের ভারসাম্য তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগেন রব, ‘কাউন্টিগুলো কেবল স্বপ্ন ফেরি করে না। তারা পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারটাও খেয়াল রাখে। ফলে কঠোর পরিশ্রম করাতে হয়। কিন্তু খেলাটা উপভোগ না করলে সব মাটি হতে বাধ্য। তাই কোচ এবং বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হয়। আমরা শুরু থেকেই ক্রলি যেন ক্রিকেট উপভোগ করে তা নিশ্চিত করতে চেয়েছি।’ ক্যারিয়ারের শুরুতে সব ঠিকই চলছিল। কিছুদিন পর ট্রিগার মুভমেন্ট নিয়ে সমস্যায় পড়লেন ক্রলি। রব কি বলেন, ‘এটা নিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের বিশেষ অবসেশন আছে। অথচ বাস্তবতা হলো কারও ট্রিগার মুভমেন্ট থাকেই না। আসল ব্যাপার হলো কে কীভাবে রান পাচ্ছে। যদি নিজস্ব টেকনিকে কেউ সফল হয় কোচের উচিত সেটাই রেখে দেওয়া।’ ১৭ বছর বয়সে জ্যাক ক্রলি পেশাদার ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। এরপর তার মনে হয় ট্রিগার মুভমেন্ট ঠিক না হলে তিনি রান পাবেন না। কোচকে বলেন, ‘আমি বুঝতেই পারছি না কখন পজিশন নিতে (ট্রিগার) হবে। কোন ভারসাম্য থাকছে না।’ পরে নেটে নিজেই খেটে খেটে সমস্যা সমাধান করেছিলেন ক্রলি। সেই সমাধান কতটা নিখুঁত ছিল তা বোঝা গেছে পাকিস্তানের পেস আর স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে তার নড়াচড়া দেখে। ক্রলিকে স্পিন খেলা শেখানোর জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছিল। তবে এত কিছুর পরেও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার প্রতি ক্রলি সুবিচার করতে পারেননি। তবু গত বছর নিউজিল্যান্ড সফরের টেস্ট দলে তিনি ডাক পেয়েছিলেন নটিংহ্যাম্পশায়ার ও ওয়ার্কশায়ারের বিপক্ষে সেঞ্চুরির জন্য।
×