ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষক বাঁচাতে চায় সরকার ॥ ২৫ পাটকল পুনরায় দ্রুত চালুর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১১ আগস্ট ২০২০

কৃষক বাঁচাতে চায় সরকার ॥ ২৫ পাটকল পুনরায় দ্রুত চালুর উদ্যোগ

রহিম শেখ ॥ চলতি সপ্তাহেই বাজারে উঠবে নতুন পাট। এ মৌসুমে প্রায় ৩০ শতাংশ পাট খেত থেকে তুলেছেন কৃষক। এ বছর ৮২ লাখ বেল পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর কৃষকের কাছ থেকে ১৩ লাখ বেল পাট কিনত সরকারী পাটকলগুলো। তাই এবার কৃষক বাঁচাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারী ২৫ পাটকল পুনরায় দ্রুত চালু করতে চায় সরকার। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) বলছে, অর্থ বিভাগের পরামর্শে এগুলো চালুর পর তরুণ ও কর্মক্ষম শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কোন মিলে অব্যবহৃত জমি পতিত ফেলে না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য পাটপণ্য বহুমুখীকরণ শিল্প স্থাপনেরও চিন্তাভাবনা চলছে। এছাড়া বেসরকারী খাতে পাটকলগুলো ছেড়ে দিতে অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চায় সরকার। এ নিয়ে দুই দফায় সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করেছে টাস্কফোর্স। এসব বৈঠকে পাটকলের জমি দীর্ঘমেয়াদী লিজ পেতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন স্টেকহোল্ডাররা। এছাড়া সরকারী মিলগুলো সরেজমিন পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। জানা গেছে, সোনালি আঁশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওতায় ৭৬টি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমতে কমতে ২৫-এ গিয়ে ঠেকে। গত ২ জুলাই পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও বেসরকারী খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করতে পারছে। বন্ধ ঘোষণার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাট শিল্পকে আবার কীভাবে প্রতিযোগিতায় আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনা থেকেই পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। সেই কর্মপরিকল্পনার একটি সারাংশ চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠিয়েছিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। সেই সারাংশে স্বাক্ষর করে কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে মত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাটকলগুলো দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশও দিয়েছেন। কৃষি তথ্যসেবা সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে পাট চাষী ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চার কোটি মানুষের জীবিকা পাটকে কেন্দ্র করে। প্রতিবছর মৌসুমে গড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পান কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, চলতি মৌসুমে ৮২ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ৭ দশমিক ২৬ হেক্টর জমিতে এবার পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। রবিবার পর্যন্ত প্রায় ৩০ শতাংশ পাট কাটা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে বাজারে পাট উঠতে শুরু করবে। বিজেএমসির তথ্য অনুসারে, সরকারী পাটকলগুলো প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখ বেল পাট কিনে থাকে। গত বছর গড়ে মণপ্রতি প্রায় দুই হাজার টাকা দর পেয়েছেন কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বেশি পাট উৎপাদন হয় ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায়। এসব জেলার পাটচাষীদের মধ্যে পাট বিক্রি এবং ন্যায্য দর পাওয়া নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন হয় ফরিদপুর ও টাঙ্গাইলে। এসব জেলার একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, সরকারী পাটকল বন্ধে চিন্তিত তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উৎপাদিত পাটের ৫০-৫৫ লাখ বেল ব্যবহার হয় বেসরকারী খাতের পাটকলগুলোতে। স্থানীয় বাজার থেকে ফড়িয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছর পাট সংগ্রহ করে বেসরকারী খাতের মিলগুলো। তবে সরকারী পাটকলের মতো বড় গুদাম না থাকায় মৌসুমে প্রয়োজনীয় পাট কেনা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। তবে সরকার চাইলে রফতানি করতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও পুনর্বিন্যাস করে বিজেএমসির বন্ধঘোষিত মিলগুলো জরুরী ভিত্তিতে চালু করতে কাজ করছে সরকার। অবসায়নের পরে দেশের পাটকলগুলো সরকারী নিয়ন্ত্রণে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি), যৌথ উদ্যোগ জিটুজি বা লিজ মডেলে পরিচালনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব আবার উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে মিলগুলোকে উপযুক্ত ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও পুনঃচালু এবং বিজেএমসির জনবল কাঠামো পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে যৌক্তিকীকরণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠিত উচ্চপর্যায়ের দুটি কমিটি ইতেমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে। তিনি বলেন, সরকার পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সচেষ্ট রয়েছে। এজন্য ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, পাট ক্রয়-বিক্রয় সহজ করতে এসএমএসভিত্তিক কেনাবেচার ব্যবস্থা, কাঁচাপাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, পাটজাত পণ্য রফতানিতে প্রণোদনা ও অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়াতে কাজ চলছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ পাটকল দ্রুত চালু করতে গত ৫ আগস্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে করেছে টাস্কফোর্স। এসব বৈঠকে পাটকলের জমি দীর্ঘমেয়াদী লিজ পেতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন স্টেকহোল্ডাররা। এছাড়া সরকারী মিলগুলো সরজমিনে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর রউফ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বন্ধ হওয়া মিল চালুর বিষয়ে উদগ্রীব। এজন্য ঈদের পরপরই স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করেছি। সেখানে পাটমিলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ্যাসোসিয়েশন ও বেসরকারী বড় বড় পাটকল মালিকরা অংশ নিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যক্তিরা পিপিপি বা যৌথ উদ্যোগ বা জিটুজি পদ্ধতিতে পুনরায় মিল চালু করার ব্যাপারে আগ্রহ কম দেখিয়েছেন। কারণ তারা পিপিপি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। তারা মিলের জমি দীর্ঘমেয়াদে লিজ পেতে আগ্রহ দেখিয়েছেন বেশি। দু-একজন অবশ্য অন্য প্রস্তাবও দিয়েছেন। কোন কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে বিজেএমসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘মিলগুলো কীভাবে চালু হবে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা তরুণ ও কর্মক্ষম শ্রমিক পুনর্নিয়োগের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারণ দেশে দক্ষ শ্রমিক থাকতে বিদেশী শ্রমিক দিয়ে মিল চলতে পারে না। অন্যদিকে বিভিন্ন মিলে অব্যবহৃত জমি কাজে লাগানোর চিন্তা চলছে। এখানে জুট ডাইভার্সিফিকেশন বা পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ কারখানা স্থাপনের চিন্তা রয়েছে। এজন্য বিনিয়োগ প্রস্তাবও রয়েছে। আপাতত পাটকলের জমিতে পাটের বাইরে অন্য কিছু করার চিন্তা সরকারের নেই।’ এর আগে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন বন্ধ ঘোষিত পাটকলের শ্রমিকদের অবসান-পরবর্তী সময়ে মিল ও বিজেএমসির অন্য সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার বিষয়ে কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নিয়ে নীতিনির্ধারণী কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। গত ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সভাপতিত্ব করেন। সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প সচিব বন্ধ থাকা মিলের পুনঃচালুকরণ বিষয়ে তাদের মতামত ও পরামর্শ দেন। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বিজেএমসি ও বণিক সমিতি এফবিসিসিআই আলাদা আলাদা পরামর্শ দেয়। ওই বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অন্য কোন কাজে পাটকলের জমি বিক্রয় করা যাবে না, মিল চালুর ক্ষেত্রে তরুণ ও কর্মক্ষম শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া ও পিপিপিতে মিল চালুর ক্ষেত্রে সরকার ও মালিকের শেয়ারের ভিত্তি জমির মূল্য অনুসারে করা। এছাড়া অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন। ওই সভায় অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, কোন অবস্থায়ই মিলের জমি বিক্রি করা যাবে না। ভাড়াভিত্তিক ইজারার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুবিধার্থে মেয়াদ বাড়ানো, মিলে থাকা কাঁচামাল, তৈরি পণ্য, যন্ত্রপাতি ও অন্য সম্পত্তির দ্রুত ইনভেন্টর, বিজেএমসি কর্তৃক নিয়মিত মিলগুলো পর্যবেক্ষণ, মিল চালুর ক্ষেত্রে তরুণ ও কর্মক্ষম শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় সরকার ॥ অতীতে বেসরকারী খাতে পাটকল ছেড়ে দেয়ার অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর নয়। কয়েকটি পাটকল লোকসানের দায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। হস্তান্তর চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া চারটি পাটকল সরকার ফিরিয়ে নেয় গত ২০১৭ সালে। পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী সরকার, বিজেএমসি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধের জন্য বারবার পত্র দেয়া সত্ত্বেও পাওনা পরিশোধ করেনি বেসরকারী খাতে দেয়া মিল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও দায়দেনা পরিশোধ না করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে মিল বন্ধ রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি না করে চুক্তিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছে। শেয়ার মূলধনের অবশিষ্ট টাকা পরিশোধের জন্য বারবার পত্র দেয়া হলেও মিলের ক্রেতারা ওই অর্থ পরিশোধ করেনি। সরকার ও সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যাবতীয় পাওনা পরিশোধের আগে মিলের কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে বিক্রয়/হস্তান্তর না করার জন্য চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও মিলের যাবতীয় মেশিনারি ও স্থাপনা সরকারের অজান্তে বিক্রি করে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এজন্য এবার অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলো চালু করতে চায় সরকার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পাটকলগুলো পরিচালনার জন্য কাদের দেয়া হবে, সেটি যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় না হয়। অতীতে অন্যান্য খাতের বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার পর সরকারী কলকারখানার জমি হাতছাড়া হয়ে গেছে। অনেকগুলোর চরিত্রই পাল্টে ফেলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পিপিপির মাধ্যমে পাটকলগুলো লাভজনক করতে হলে ভাল পরিকল্পনা থাকতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। বর্তমানের মতো অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হবে না। সে জন্য শ্রমিকের ন্যায্য দেনা-পাওনা পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সরকারী পাটকলের পুনর্গঠনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পাটকলগুলোর আকার যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করে সরকারী খাতে রেখে বা ব্যবস্থাপনা বেসরকারী খাতে ছেড়ে দিয়ে কিংবা সরকারী-বেসরকারী অংশীদারীত্বের (পিপিই) ভিত্তিতে পরিচালনার মাধ্যমে পুনর্গঠন সম্ভব। বর্তমানে পিপিপির মাধ্যমে পরিচালনার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে করতে হবে।’ বেসরকারী পাটকলগুলো যেভাবে এগিয়েছে ॥ ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়ার বিসিক শিল্প এলাকায় সাড়ে পাঁচ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। বেসরকারী খাতের মিলটি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটের সুতা বিক্রি করে মুনাফা করেছে ছয় কোটি টাকা। দেশে বেসরকারী খাতে অন্যতম বড় পাটকল আকিজ জুট মিলস। গত ২০১৫ সালে ৮১ হাজার ৩৩৮ মেট্রিক টন পাটপণ্য রফতানি করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬২ মেট্রিক টন। তার মানে তিন বছরের ব্যবধানে আকিজের পাটের সুতার রফতানি বেড়েছে ২৪ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টন। অন্যদিকে সরকারী পাটকলের রফতানি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৩৫ কোটি টাকা হলেও পরের বছর সেটি কমে ২৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, গত বছর যেখানে আকিজ একাই ১ লাখ মেট্রিক টন পাটপণ্য রফতানি করেছে, তার বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে-বিদেশে সরকারী ২২টি পাটকলের পাটপণ্য বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ বা ৫৮ হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে বিজেএমসি। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করা সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ পাটপণ্য ব্যবসায় ভাল করছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, কাঁচা পাট কেনা থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার পাটের বস্তার দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে। কিন্তু বিজেএমসি দিনের পর দিন একটি মূল্য নির্ধারণ দিয়ে রাখে। সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির কারণেই পাটকলগুলো টিকে ছিল বলে মন্তব্য করেন মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বেসরকারী খাতের শতাধিক জুট স্পিনিং মিলে বছরে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন পাট সুতা উৎপাদনে কাজ করেন ৬৫ থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক। আর সরকারের পাটকলে ৫০-৬০ হাজার মেট্রিক টন পাটপণ্য উৎপাদনে স্থায়ী ও বদলি শ্রমিক মিলে কাজ করেন ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে বিজেএমসির পাটকল লাভ করবে কীভাবে? বিশে^ পাট পণ্যের বড় ধরনের চাহিদা দেখছেন উদ্যোক্তারা ॥ ইপিবির তথ্যমতে, বেসরকারী খাতে ৭০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্য রফতানি হয় বছরে। দেশের বাজারে বিক্রির পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিজেএমসি রফতানি করেছে ২৬৪ কোটি টাকার পণ্য। এ সময় বেসরকারী খাতের রফতানির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। করোনাভাইরাস মহামারীকালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় বাড়ছেই। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি আয় করেছে বাংলাদেশ। এই খাত থেকে এক মাসে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার আয় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজেএমএর মহাসচিব আব্দুল বারেক খান বলেন, স্থানীয়ভাবে বস্তার চাহিদা বেশি। ৮০ কোটি পিস বস্তার চাহিদা আছে দেশে। ১৩৫ কোটি পিস বস্তা তৈরির সক্ষমতা আছে বেসরকারী খাতের। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব এখন সবুজায়নে জোর দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮ দেশ পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ওই দেশগুলোয় বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হবে। পাটবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে বছরে পাঁচ হাজার কোটি পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক আঁশ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই দেড় হাজার কোটি ডলারের শপিং ব্যাগের বাজার তৈরি হবে। এছাড়া পাটের শপিংব্যাগ, সৌখিন ও আসবাবসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনেরও সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববাজারে শুধু পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে ৫০০ বিলিয়ন পিস। এতে পাটের তৈরি পণ্যের বড় ধরনের চাহিদা তৈরি হবে। এতে দেশগুলোতে বার্ষিক বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদার সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পাটের শপিংব্যাগ, সৌখিন ও আসবাবসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। ফলে রফতানির অন্যতম খাত হতে পারে পাট। সেই বাজার ধরতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের অভাবে সেটি ধরা কষ্টকর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, ‘বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারণে পাটের সম্ভাবনা অফুরন্ত। সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশও দখল করতে পারলে শুধু এই পাট দিয়েই বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আগামী বছর থেকে পাট শিল্প থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেও কোন স্বপ্ন নয়। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের জন্য গবেষণা বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য তৈরির জন্য দেশে দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যান্ত্রিক সুবিধা বাড়াতে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য বেসরকারী খাতকে যেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।’
×