ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে নকল মাস্ক ॥ অপরাজিতার শারমিন রিমান্ডে

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৬ জুলাই ২০২০

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে নকল মাস্ক ॥ অপরাজিতার শারমিন রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে তিন দিনের রিমান্ড নিয়েছে ডিবি পুলিশ। শনিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে শারমিনকে মুখ্য মহানগর আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন শাহবাগ থানার মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মোঃ আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মইনুল ইসলাম তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে শারমিন জাহানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরই তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী সাবেক এই ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার রাতে বিএসএমএমইউয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেন। শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে এ মামলায় দণ্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এই মাস্কের কারণে কোভিড-১৯ সম্মুখযোদ্ধাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। মামলার আসামি শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদে ছিলেন। আওয়ামী লীগের গত কমিটিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ছিলেন। এর আগের কমিটিতে একই উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষে বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রশাসন-১ শাখায় সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত তিনি। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার শ্যামগঞ্জের গোহালকান্দায়। তিনি মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী। মামলায় বিএসএমএমইউয়ের প্রক্টর মোঃ মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, গত ২৭ জুন শারমিন জাহানকে ১১ হাজার মাস্ক সরবরাহের কার্যাদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। কার্যাদেশের বিপরীতে ৩০ জুন প্রথম দফায় ১ হাজার ৩০০টি, ২ জুলাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ৪৬০টি ও ১ হাজারটি এবং ১৩ জুলাই চতুর্থ দফায় ৭০০টি মাস্ক সরবরাহ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় লটের মাস্কে কোন সমস্যা ছিল না। তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় লট বিতরণ ও ব্যবহারে ত্রুটি পাওয়া যায়। মাস্কের গুণগত মান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। কোন মাস্কের বন্ধনিফিতা ছিঁড়ে গেছে, কোন মাস্কের ছাপানো লেখায় ত্রুটিপূর্ণ ইংরেজী লেখা পাওয়া গেছে। কোন কোন মাস্কের নিরাপত্তা কোড ও লট নম্বর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে নকল বলে জানা গেছে। এ কারণে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে মাস্কের গুণগত মান নিম্নমানের ছিল। মামলায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শারমিন জাহানকে ১৮ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিল। শারমিন ২০ জুলাই দেয়া জবাবে দুঃখ প্রকাশ করেন, যা দোষ স্বীকারের শামিল। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শারমিনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনী ব্যবস্থা নেয়ার অভিযোগ করেছে। আদালতে শারমিন যা বললেন ॥ শনিবার দুপুরে শারমিনকে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন পুলিশ পরিদর্শক মোঃ আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস। অন্যদিকে শারমিনের পক্ষে তার আইনজীবী পনির হোসেন জামিনের আবেদন করেন। শুনানিতে পনির জানান, তিনি (শারমিন) সরল বিশ্বাসে মাস্ক সরবরাহ করেছেন। তার কোন গিল্টি মাইন্ড ছিল না। তিনি কোন নকল মাস্ক সরবরাহ করেননি। তাছাড়া অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামের কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পুলিশ দেখাতে পারবে না। শুনানির মাঝে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শারমিন জাহান বিচারকের কাছে কিছু বলার অনুমতি চান। এরপর বিচারক তাকে অনুমতি দিলে শারমিন জাহান বলেন, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি যদি নকল মাস্ক দিয়ে থাকি তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে সেটা ফেরত দেবেন। কিন্তু সেটা না করে আমার নামে মামলা দিয়েছে। শারমিন আরও জানান, আমি প্রথম দুই বার মাস্ক দিলাম। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাস্কের মান নিয়ে কিছুই বলেনি। কিন্তু আবার যখন তৃতীয় বার মাস্ক দিলাম তখন বলা হলো যে নকল মাস্ক। যদি নকল মাস্ক আমি দিয়ে থাকি তাহলে সেটা আমাকে রিটার্ন দেবে। কিন্তু সেটা না করে আমার নামে মামলা দেয়া হলো। মূলত আমাকে ফাঁসানোর জন্য এটা করা হয়েছে। শুনানি শেষে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। বেলা পৌনে ২টার দিকে তাকে আদালত থেকে নিয়ে যায় পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে এ মামলায় দণ্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দুটি ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছর এবং সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতকোত্তর শারমিন ২০০২ সালে ছাত্রলীগের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের গত কমিটিতে তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন। বর্তমান কমিটিতে কোন পদ না পেলেও দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। শারমিন ২০১৬ সালের ৩০ জুন স্কলারশিপ নিয়ে চীনের উহানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। গত ২৩ জানুয়ারি থেকে উহানে লকডাউন শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তার শিক্ষা ছুটির মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যে চীনে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের মার্চে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানি খুলে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শারমিন জাহান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নকল মাস্ক সরবরাহ করিনি। এসব প্রোডাক্ট চীন থেকে ইমর্পোটেড। এগুলো তো আমরা তৈরি করিনি। আমরা শুধু সাপ্লাই দিচ্ছি। প্রোডাক্ট খারাপ হলে বিএসএমএমইউ প্রথমবারই আমাদের বলতে পারত। আমরা সেটা যাচাই করে দেখতে পারতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বলেছে, শারমিন জাহান শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। নকল মাস্ককাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ॥ নকল মাস্ক সরবরাহের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালকে কারণ দর্শানোর পর তাদের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীতে সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোন ধরনের আপস নয়। ইতোমধ্যে তারা মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে মামলা দায়ের ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি রবিবারের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেবে। এরপর প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তীতে আরও ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাস্ক সরবরাহ বাবদ অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউ পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ জুলফিকার আহমেদ আমিন। তিনি জানান, মোট চারটি লটে তিন হাজার ৪৬০টি মাস্ক গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ৯৫৯টি মাস্ক ফেরত দেয়া হয়েছে, আর মাস্ক নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৫০১টি। ৭৩০ টাকা হিসেবে মোট ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৭৩০ টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
×