ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বেরিয়ে আসছে অবিশ্বাস্য সব কুকীর্তি ॥ সঙ্গে সঙ্গেই বরখাস্ত করল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

জেকেজি প্রতারণার হোতা সাবরিনা গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:১৯, ১৩ জুলাই ২০২০

জেকেজি প্রতারণার হোতা সাবরিনা গ্রেফতার

আজাদ সুলায়মান ॥ করোনার চিকিৎসায় প্রকাশ্যে প্রতারণার দায়ে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে জেকেজি হেল্থ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা আরিফকে। রবিবার দুপুরে তাকে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগীয় উপকমিশনারের কার্যালয়ে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতার দেখানো হয়। গ্রেফতারের পর পরই তাকে বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সময় এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসি হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন- প্রাথমিক তদন্তে জেকেজি প্রতারণায় যথেষ্ট তথ্য প্রমাণাদি নিয়েই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ- করোনার পরীক্ষা না করেই নকল রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা। এর আগে তার স্বামীসহ আরও কয়েকজনকে এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য, জেকেজির প্রতারণায় আরিফুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর থেকেই তোলপাড় শুরু হয়। হাজার হাজার ভুক্তভোগী করোনার পরীক্ষা করাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় টনক নড়ে স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ মহলে। তারপরই বেরিয়ে আসতে থাকে স্বাস্থ্য কেলেঙ্কারির অজানা কাহিনী। এতে তোলপাড় দেখা দিলে সাবরিনাকে গ্রেফতারের দাবি ওঠে। এ অবস্থায় রবিবার দুপুর সোয়া ১টায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয় তেজগাঁও বিভাগীয় পুলিশের উপকমিশনারের অফিসে। তাকে দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদ করেন জেকেজির প্রতারণা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ডিসিসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা। দুই ঘণ্টা পর বিকেল সোয়া ৩টার দিকে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তার আরও দুই সহযোগীকে খোঁজা হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, বহুল আলোচিত ডাঃ সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। সাবরিনা আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়েছে তার। চতুর্থ স্ত্রী ডাঃ সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথ কেয়ার। প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। জেকেজি নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন স্বামীর সহায়তায়। দেশে করোনা তা-ব দেখা দেয়ার পর স্বামীর সঙ্গে মিলে মিশে যৌথভাবে জাতির এমন দুর্যোগলগ্নে চিকিৎসার নামে প্রতারণার মিশনে নামেন। যদিও গ্রেফতারের পর তিনি গণমাধ্যমে নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান নয়- বরং প্রতিষ্ঠানটির ‘কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক’ দাবি করেছেন। তবে পুলিশের তদন্ত বলছে, সাবরিনাই জেকেজির চেয়ারম্যান। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা কী বলেছেন, তা জানা না গেলেও শনিবার একটি বেসরকারী চ্যানেলকে সাক্ষাতকার দেন তিনি। সেখানে সাবরিনা দাবি করেন- আমার জেকেজির চেয়ারম্যান হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। বরং এটা ওভাল কোম্পানির একটি অঙ্গ সংগঠন। ওভাল গ্রুপ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। যেখানকার মালিক হচ্ছেন আরিফুর রহমান। জেকেজির বিষয়ে আমি ডিজি স্যারকে (আবুল কালাম আজাদ) বলেছি, এডিজিকে বলেছি। উনারা সবাই আমাদের এসব বিষয়ে অবগত আছেন। জানা গেছে, গত ৪ জুন স্বামী আরিফুলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে সাবরিনা তেজগাঁও বিভাগের একটি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। চলতি বছরের মে মাসে স্বামী আরিফের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে দাবি করেছেন সাবরিনা। সম্প্রতি সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে অর্থ নিচ্ছিল জেকেজি। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দেয়ার অভিযোগে আরিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আরিফের পাশাপাশি গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিকস ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরণ ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে জেকেজি হেলথ কেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরীও জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির সাত-আট কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন। এ ঘটনার পর পুলিশ নিশ্চিত হয়- নমুনা সংগ্রহের জন্য জেকেজির হটলাইন নম্বরে ফোন করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেকে জেকেজির বুথে এসে নমুনা দিতেন। বিদেশী নাগরিকদের জন্য নেয়া হতো ১০০ ডলার। বাংলাদেশীদের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। যদিও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ভিত্তিতে বিনামূল্যে তাদের স্যাম্পল কালেকশন করার কথা ছিল। এসব ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পুলিশের কাছে তথ্য ছিল, তারা করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেয়। তাদের গ্রেফতারের পর জানা যায়, জেকেজি হেলথ কেয়ারে তানজিনার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা কামানো দেখে তানজিনা প্রতিষ্ঠানটির কাছে আরও বেশি বেতন দাবি করে। বিষয়টি জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরী জেনে তানজিনা ও তার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করে। পরে তারা দুজন বাসায় বসে নিজেরাই করোনার ভুয়া টেস্ট করে মানুষকে রিপোর্ট দেয়া শুরু করে। তানজিনা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করত, আর ঘরে বসে তার স্বামী রিপোর্ট তৈরি করত। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতার হওয়ার পর তানজিনা ও তার স্বামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সব বলে দেয়। এরপর ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতারক আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের দুদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা হয়। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মী আরিফকে ছাড়িয়ে নিতে তেজগাঁও থানায় জড়ো হয়। তারা থানার বাইরে হট্টগোল করতে থাকে। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, জেকেজি হেলথ কেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। জেকেজির মাঠ কর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করত। প্রতি রিপোর্টে পরীক্ষার কথা বলে ৫-১০ হাজার টাকা নিত। আর বিদেশীদের কাছ থেকে নিত ৮০ থেকে ১০০ ডলার। সেই হিসাবে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। এভাবেই করোনায় নকল সনদের প্রতারণা করেছে এই দম্পতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি হারুন অর রশীদ বলেন, জেকেজির কর্মকাণ্ড ও তার কর্মকাণ্ড নিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। আমরা মনে করি, যে কোম্পানি মানুষকে ক্ষতি করছে, যারা করোনা নেগেটিভকে পজিটিভ আর পজিটিভকে নেগেটিভ বানাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে আমরা তাকে গ্রেফতার করি। যেহেতু তিনি একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তিনি কোনভাবেই একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না, আবার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সেই কোম্পানির মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতে পারেন না। উনি যেহেতু ফেসবুকেও জেকেজির পক্ষে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তাই জেকেজির কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না। এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে ডিসি হারুন বলেন, ২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরণ ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে আটক করে পুলিশ। হিরণ আমাদের জানায়, সে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করত। এই ভয়ানক তথ্য জানার পর আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি এর সঙ্গে কারা জড়িত। সে স্বীকার করেছে, কোর্টেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে যে ভুয়া রিপোর্টের সঙ্গে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত। তখন জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করি। গ্রেফতার সিইওকে আমরা জিজ্ঞেস করি- এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কে। উত্তরে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী। এরপর একে একে ছয়জনই এক উত্তর দিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি হারুন বলেন, তার বিরুদ্ধে আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছিলাম। তদন্ত কর্মকর্তা গ্রেফতারের জন্য একটু সময় নিয়েছে, যেহেতু সাবরিনা চৌধুরী একজন ডাক্তার এবং একজন সরকারী কর্মকর্তা। বরখাস্ত করা হয়েছে সাবরিনাকে ॥ এদিকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হৃদরোগ হাসপাতাল থেকে ডাঃ সাবরিনা আরিফকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রবিবার মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ কথা জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে হৃদরোগ হাসপাতালের পরিচালক মীর জামাল উদ্দিন বলেন, তার গ্রেফতারের খবর টেলিভিশনে দেখেছি। তারপর সাড়ে পাঁচটার দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর মহাপরিচালক বরাবর তাকে বরখাস্তের জন্য আবেদন করি। এইমাত্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হলো তাকে হাসপাতাল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনে তাকে বরখাস্তের জন্য আবেদন করা হয় বলেও জানান মীর জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পদে থাকা অনৈতিক। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেজিস্ট্রার চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ডাঃ সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও তিনি গণমাধ্যমে পরিচিত ছিলেন জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান হিসেবে। পরে অবশ্য গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েই জানান তিনি জেকেজি হেলথ কেয়ারের মালিকানা বা চেয়ারম্যান পদে না থাকার বিষয়ে। বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেছিলেন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে অফিস টাইমে তিনি জেকেজি হেলথ কেয়ারে সময় দিতেন একজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে। তবে জেকেজির কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ায় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সাবরিনার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা আলোচিত বিষয় ভাইরাল হয়। বিশেষ করে কেন সে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে- এসব প্রশ্নে ফেসবুকে ঝড় ওঠে।
×