ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা-গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ

প্রকাশিত: ১৭:১৫, ৩ জুলাই ২০২০

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা-গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ

অনলাইন রিপোর্টার ॥ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে মত প্রকাশের জের ধরে দেশজুড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যাপকহারে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আর্টিকেল নাইনটিন। শুক্রবার সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, লেখক, সাংবাদিক ও কার্টুনিস্টের গ্রেফতার চলমান কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতা, দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার সংকটকেই আরও প্রকট করে তুলেছে। আর্টিকেল নাইনটিন এসব গ্রেফতারের ঘটনায় নিন্দা জানায় এবং একইসঙ্গে গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি ও দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল শুরু থেকেই। নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে তৃণমূলে ত্রাণ বিতরণ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা, অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো দিনে দিনে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার এসব দুর্বলতা কাটানোর প্রতি মনোযোগী হবে। অথচ এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিন্নমত ও সমালোচনা দমনের নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করায় নবম শ্রেণির কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেফতারের ঘটনা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত। মোবাইলে কথা বলার ওপর কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনায় ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে কটূক্তির অভিযোগে গত ২০ জুন ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রকে গ্রেফতারের পর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কেবল মত প্রকাশের কারণে সম্প্রতি লেখক, কার্টুনিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক-সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফারুখ ফয়সল বলেন, অন্যান্য আইনে দায়েরকৃত মামলার তুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সম্প্রতি রংপুর ও রাজশাহীতে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে, যাদের একজন নারী, মামলা দায়েরের পর পরই কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ হত্যাচেষ্টা ও দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিরা চার্টার্ড ফ্লাইটে দেশত্যাগ করেছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিষয়ে কোনো তৎপরতা দেখায়নি। আইন প্রয়োগের এই বৈষম্যমূলক প্রবণতা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে। স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চা নির্বিঘ্ন হওয়া প্রয়োজন। অথচ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের দেওয়া এ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইন প্রয়োগের নিয়মিত আহ্বান সত্ত্বেও, সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। আর্টিকেল নাইনটিন মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করে। মতপ্রকাশজনিত ঘটনায় ২০১৮ সালে ৭১টি ও ২০১৯ সালে ৬৩টি মামলা রেকর্ড করে আর্টিকেল নাইনটিন। অথচ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই সংস্থাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ১১৩টি মামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে। কেবল মত প্রকাশের কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২০৮ জন ব্যক্তি এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৩ জনই সাংবাদিক। অভিযুক্তদের মধ্যে ১১৪ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই এখনো জামিনের প্রতীক্ষায় আছেন। এ প্রসঙ্গে ফারুখ ফয়সল বলেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কারাবন্দিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল আদালতে ৩০ দিনে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ৪৫ হাজার ব্যক্তির জামিন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্তরা খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ভয়ঙ্কর কোনো মামলার আসামি নন। তবুও তাদের জামিন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পক্ষকাল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের জামিন আবেদন এ পর্যন্ত আটবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে; যা তার পরিবারের জন্য অত্যন্ত হতাশার। আমরা কাজল ও ওই স্কুলছাত্রসহ মতপ্রকাশের কারণে এই আইনে গ্রেফতার অন্য অভিযুক্তদের অবিলম্বে মুক্তি ও সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই।
×