ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন আহম্মেদ হীরা

স্মরণ ॥ ভোলা যায় না তোমায় মহীয়সী নারী

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৪ জুন ২০২০

স্মরণ ॥ ভোলা যায় না তোমায় মহীয়সী নারী

অপ্রত্যাশিত বিয়োগান্তে শোকের কালো মেঘ ছেয়ে ফেলেছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সূতিকাগার সেরনিয়াবাত পরিবারকে। মৃত্যু অমোঘ সত্য কিন্তু কেউই শহীদ জননী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগমের অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। একই সঙ্গে বরিশালজুড়ে আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের একমাত্র ভরসাস্থল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মমতাময়ী সাহান আরা বেগমের শূন্যতায় বরিশালজুড়ে শোকের ছায়া বয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সহধর্মিণী সাহান আরা বেগমের আকস্মিক মৃত্যুতে স্বামী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য মন্ত্রী আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি ও জ্যেষ্ঠ পুত্র বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ শোকে এখনও স্তম্ভিত। সেই সঙ্গে মেঝ পুত্র এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সেরনিয়াবাত মঈন আব্দুল্লাহ ও কনিষ্ঠ পুত্র জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেরনিয়াবাত আশিক আব্দুল্লাহ শোকে মূহ্যমান। করোনার প্রভাবে একত্রিতভাবে বৃহৎ পরিসরে মরহুমা সাহান আরা বেগমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকলেও বরিশাল মহানগরীসহ জেলার দশটি উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার জামে মসজিদে নেতাকর্মীদের উদ্যোগে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইতোমধ্যে দোয়া-মিলাদ এবং কয়েক শ’ মন্দিরে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়াও প্রশাসনিক ও বিভিন্ন সামাজিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিনিয়ত দোয়া-মিলাদ অব্যাহত রয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন নগরীর মুসলিম গোরস্তানে মরহুমা সাহান আরা বেগমের সমাধিস্থলে জড়ো হচ্ছেন আত্মার মাগফিরত কামনায়, দিচ্ছেন শ্রদ্ধাস্বরূপ ফুল। ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে সাহান আরা বেগমের অন্তিম শয়নস্থল। শহীদ জননী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম শুধু বরিশালেই নয়; মেধা ও দক্ষতায় তিনি তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক কর্মকাÐে ঢাকা পর্যন্ত নিজের পরিচিতি পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি সাবেক সফল চীফ হুইপ ও বর্তমানে পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকা আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির সহধর্মিণী এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর মা। সেই হিসেবে তার (সাহান আরা বেগম) মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে বরিশালে লাখো মানুষের ঢল নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মহামারী করোনার প্রকোপের কথা চিন্তা করে সেরনিয়াবাত পরিবারের নিকটতম আত্মীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বরিশালে কোন রকম আয়োজনের কর্মসূচী রাখা হয়নি। বরং বরিশালের দ্বিতীয় জানাজায় লোক সমাগমের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে স্বল্পসংখ্যক লোকের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এ মহীয়সী নারী সাহান আরা বেগমকে নগরীর মুসলিম গোরস্তানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয়েছে। এর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত ৭ জুন রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সাহান আরা বেগমের মৃত্যুর পর হাসপাতাল চত্বরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার দীর্ঘ বছরের সুখ ও দুঃখের সঙ্গী সাহান আরা বেগমকে হারিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে হওয়ার সুবাধে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে হাসানাত দম্পতিকে এতদাঞ্চলে মুজিব বাহিনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে শত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সাহান আরা বেগম নিজে গুলিবিদ্ধ হয়েও চোখের সামনে বড় ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের ছটফট করে মৃত্যু দেখেছেন। একই সঙ্গে সাহান আরা বেগম পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর নির্মমতা দেখেছেন। ঘাতকের নির্মম বুলেটে বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অসংখ্য সদস্য নিহত এবং নিজের স্ত্রী ও পরিবারের কয়েক সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের চিকিৎসার জন্য ওই সময় কিছুই করতে পারেননি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। বরং ঘাতকদের চলে যাবার পর ঢাকার মিন্টো রোডের বাড়ির একটি রুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ স্ত্রীর অনুরোধে দেশ থেকে পালিয়ে দীর্ঘদিন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার (হাসানাত) অনুপস্থিতিতে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে, আবার কখনও আত্মগোপনে থেকে শোকের সংসারে দীর্ঘদিন পর্যন্ত হাল ধরে রাখেন মমতাময়ী সাহান আরা বেগম। প্রবাসে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্ত্রী লিপি আব্দুল্লাহ ও সন্তানরা তার সঙ্গে শোকের সাগরে ভাসলেও স্বামী সাদিক আব্দুল্লাহকে ফোনে সান্ত¡না দিয়ে রাখছেন। বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বিমান চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় প্রিয় শাশুড়ির মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও লিপি আব্দুল্লাহ তার সন্তানদের নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। লিপি আব্দুল্লাহ তার শাশুড়ি সাহান আরা বেগমের প্রতি ছিলেন গভীর দুর্বল। সেই প্রিয় শাশুড়ির মৃত্যুর সংবাদে তিনিও এখন ভঙ্গুর মানসিকতায় শোকে মূহ্যমান। গোটা সেরনিয়াবাত পরিবার এখন সাহান আরা বেগমের শূন্যতা অনুভবে কাতর হয়ে পরেছেন। একসময় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেরনিয়াবাত পরিবারের হঠাৎ শোকের যে ছায়া নেমে এসেছে তা কিভাবে এবং কবে নাগাদ কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হবে তা কেবল সৃষ্টিকর্তার ওপরই নির্ভর করছে। একই সঙ্গে বরিশালের ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ভর করছে এ পরিবারের ওপর। সাহান আরা বেগমের আস্থাভাজন গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বরিশালজুড়ে যখন আওয়ামী লীগ সমর্থক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর বিএনপির সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হামলা, ভাংচুর, খুন, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা চলছে তখন সাহান আরা বেগম খবর পেয়েই প্রতিটি স্থানে ছুটে গিয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাহস জুগিয়ে মাতৃ¯েœহ দিয়ে রেখেছেন। সেই থেকে দলের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের তিনি ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল। তার সেই স্থান কোন দিন পূরণ হওয়ার নয়। সেই মহীয়সী নারী সাহান আরা বেগম গত ৫ জুন আকস্মিকভাবে ঢাকার কলাবাগানের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৭ জুন রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। বরিশালের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাহান আরা বেগমের মৃত্যুকে ঘিরে বরিশালজুড়ে শোকের ছায়া বয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সড়ক ও মহাসড়কে বিশালাকার কালো আকৃতির বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফ্যাস্টুনে শোভা পাচ্ছে সাহান আরা বেগমের ছবি সংবলিত শোকের বাণী গাঁথা বিভিন্ন লেখায়- ‘ভোলা যায় না তোমায় হে মহীয়সী নারী, স্মৃতির পাতায় তুমি রবে অনন্তকাল বরিশালে।’ লেখক : সাংবাদিক
×