ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

রেড, ইয়েলো, গ্রীন ॥ করোনা ঠেকাতে তিন জোনে ভাগ হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২ জুন ২০২০

রেড, ইয়েলো, গ্রীন ॥ করোনা ঠেকাতে তিন জোনে ভাগ হচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ করোনা পরিস্থিতি দিন দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনুযায়ী সারাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দুই মাসের লকডাউন শেষে সব খুলে দেয়ার পর ফের ভাইরাস সংক্রমণ রোধে নতুন এই পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। এই পরিকল্পনার আওতায় সারাদেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ (রেড, ইয়েলো ও গ্রীন) জোনে ভাগ করা হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। লকডাউনের পর সীমিত পরিসরে অফিস খোলার দ্বিতীয় দিন সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক শেষে তিনি একথা বলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর যেসব এলাকা বেশি আক্রান্ত সে এলাকাকে রেড জোনের আওতায় নেয়া হবে। আর এই রেড জোনে কিছু দিনের জন্য প্রায় সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। ওই জোনে নির্ধারিত কিছু লোক ছাড়া অন্য কেউ বাইরে যেতে এবং ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। মূলত এলাকাটি অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকবে। হলুদ জোনে দেখে শুনে সতর্কতার সঙ্গে কাজকর্ম চলবে। আর সবুজ জোনে আরও বেশি মাত্রায় কাজ কর্ম চলবে। তবে সকল এলাকায় সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ঝুঁকি আর শঙ্কার মধ্যেই খুলেছে সরকারী সকল অফিস, ব্যাংক, বীমা। জীবন ও জীবিকা রক্ষায় মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ কর্মকা-ে ফিরতে হচ্ছে নতুন বাস্তবতায় অভ্যস্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে গণপরিবহনের চাকাও। বাস-লঞ্চ-ট্রেন-বিমান চলছে। খুলেছে পুঁজিবাজার। ব্যাংকে লেনদেন আগের মতোই চলবে। সচল হচ্ছে দেশ। এখন সবাইকে বাইরে বের হতে হবে স্বাভাবিক সময়ের মতোই, কিন্তু সর্বক্ষণ সচেতন থাকতে হবে নিজে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে। দূরত্ব রক্ষা করে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিকে করে নিতে হবে জীবনের সঙ্গী। প্রতিটি স্তরের কার্যক্রম চালাতে মানতে হবে সরকার নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধি। সরকারী-বেসরকারী অফিসের জন্য যেমন দেয়া হয়েছে ১৩ দফা গাইডলাইন তেমনি গণপরিবহনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালু করতেও মানতে হবে শর্ত। গত ২৬ মার্চ থেকে চলা সাধারণ ছুটির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে জারি করা ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণের পাশাপাশি সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরে অফিসে আসতে বলা হয়েছে। তবে বয়স্ক, অসুস্থ ও সন্তান সম্ভবাদের এ সময় অফিসে আসা মানা। এরই মধ্যে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, অফিসে ২৫ শতাংশের বেশি উপস্থিত হওয়া যাবে না। বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে সরকার দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে চাচ্ছে বলে, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়। করোনা আক্রান্ত দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অর্থনীতি সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী আক্রান্তের ওপর ভিত্তি করে দেশকে তিন ভাগে ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে অনুযায়ী তিনি নির্দেশ দেয়ার পর সোমবার জরুরী বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আমাদের টেস্টের হার বাড়ছে, টেস্টের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণের সংখ্যাও বাড়ছে। সেজন্য আমরা কয়েকটি জোনÑ রেড জোন, ইয়েলো জোন, গ্রীন জোন মার্কিং করছি। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল যে, রেড জোনকে কীভাবে গ্রীন জোন করা যায়। সেটা নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক কথা বলেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এগুলো নোট করেছেন। তিনি এগুলো বাস্তবায়ন করবেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটা পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দেবেন। আমরা খুব শীঘ্রই সেটা বাস্তবায়ন করব। পরে জোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, জোন এখনও করা হয়নি। করা হবে। যখন জোন করব আপনারা জানতে পারবেন। আপনারা জানেন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ইদানীং চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। যদি কোন জোন রেড হয়ে থাকে, তবে এগুলোই হয়তো রেড হবে। আর বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলা এখনও অনেকাংশ ভাল আছে। আমরা সেটা ভাল রাখতে চাই। রাখার জন্যই এই সভা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে গত শনিবার আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী আমরা বৈঠকে বসলাম। আমরা একটা পরিকল্পনা তৈরি করে দেব। পরিকল্পনাটা নিয়ে এখানে নীতিগতভাবে আলোচনা হয়েছে। আমরা পরিকল্পনাটাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে করে দেব। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সিটি কর্পোরেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকারের লোকজন এবং আমরাও থাকবÑ সবাই মিলে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব। জোনিংটা কীভাবে করা হবে, বিশেষজ্ঞরা সেই পরিকল্পনাটা করবেন বলেও জানান জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, জোনিংয়ের মাধ্যমে যে জোনটায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হবে, যেমন ধরুন একটা ছোট্ট এলাকা আমরা বলব, এই এরিয়াটা বন্ধ থাকবে এই কয়দিনের জন্য। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেবেন সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ রেড জোনের মধ্যে পড়বে কিনা- জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এটাতো বিশেষজ্ঞরা ঠিক করবেন। আমরা তো মনে করি এগুলো রেড জোন হওয়া উচিত। কারণ এখানে তো অনেক সংক্রমিত। কী পরিকল্পনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত এটাই। এখন বিশেষজ্ঞরা তারা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন বা জোনিং করবেন সেটা তারা জানেন। এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখনও জোন করা হয়নি। যখন করা হবে তখন জানতে পারবেন। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, জোনিংয়ের মাধ্যমেই সব করা হবে। যে জোনের মধ্যে খুব বেশি সংক্রমিত হবে; ছোট্ট এলাকা, ঢাকার ভেতরে ধরেন একটা ছোট্ট এলাকা-সেখানে হয়তো একটি এলাকাকে বলব যে, এই এলাকা বন্ধ থাকবে এই কয় দিনের জন্য। এভাবে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেবে, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করব। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় জোনে ভাগ করা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি। তবে গত শনিবার এ বিষয়ে নিজের ভাবনা এক সাক্ষাতকারে তুলে ধরেছিলেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। ভাইরাস সংক্রমণের এই অবস্থায় অফিস, কারখানা, গণপরিবহন চালুর সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, অর্থনীতি সচল করার জন্য এগুলো করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তা না হয়ে উল্টো ফল দিতে পারে। আহসান মনসুর জানান, এই সঙ্কট মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্চ মাসের শুরুতেই তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সারাদেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, রেড জোন অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকা-সহ সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে; একেবারে জরুরী অবস্থার মতো। কোন কিছু চলবে না, সবাই বাসায় থাকবে। হলুদ জোনে দেখে-শুনে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা- চালাতে অনুরোধ করেছিলাম। আর সবুজ জোনে মোটামুটি অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে বলেছিলাম। তার ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের নিরিখে সারাদেশকে লাল, সবুজ ও হলুদ জোনে ভাগ করার পরিকল্পনা হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। এই ভাগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জকে রেড জোনে ফেলা হবে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে। জবাবে তিনি বলেন, এ কাজ বিশেষজ্ঞরা করবেন। তবে আমরা মনে করি রেড জোন হওয়া উচিত, কারণ এখানে তো অনেক সংক্রমিত।
×