ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

আনিস স্যারের জীবনটাও কেড়ে নিল নিষ্ঠুর ভাইরাস

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ২৩ মে ২০২০

আনিস স্যারের জীবনটাও কেড়ে নিল নিষ্ঠুর ভাইরাস

আমাদের তিন পুরুষের প্রিয় অভিভাবক আনিসুজ্জামান স্যারের জীবনটাও কেড়ে নিল করোনা নামক অদৃশ্য নিষ্ঠুর দানব। এই দানবের ওপর আল্লাহর লা’নত পড়ুক এ দোয়া করে স্যারের ওপর কিছু লিখতে শুরু করছি। শুরুতেই স্যারের রুহের মাগফিরাত কামনা করি, স্যার আপনি শান্তিতে থাকুন। রোজার দিন। টেলিভিশনে একই খবর বার বার দেখায়। একবারের বেশি দেখতেও ইচ্ছে করে না। বরং এখনও খবরের কাগজ নিয়ে সকালটা বেশ ভালই কাটে। শুক্রবার সকালটা কিন্তু ভাল কাটেনি। হকার কাগজ দিলে একটা একটা করে অভ্যাস মতো লিড নিউজে চোখ বুলাই। মনে হলো সারের প্রয়ানে গোটা বাংলাদেশে অন্ধকার নেমে এসেছে বাংলাদেশের বাইরেও। আমাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, অসাম্প্রদায়িকতার লড়াইয়ের এমন ব্যক্তিত্ব আর কে আছেন? কে আছেন? আমি ভাগ্যবানদের একজন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই। প্রথম প্রথম কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভোগছিলাম। বাংলার পরে অন্য কোন ভাষায় ভর্তি হতে পারলাম না এ জন্য। ভর্তি হবার পর যখন দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা শিক্ষকরা সব এই বিভাগেই পরান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আব্দুল হাই, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, ড. আহমদ শরীফ, ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন। চাঁদপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালেও তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। সতীর্থদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি আজকের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকারী মানবিক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুণ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যজন সেলিম আল-দীন, রাজনীতিক নূহ-উল-আলম লেলিন, নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম রাকা প্রমুখ। ভাবলাম বাংলা ভাষা সাহিত্যে ভর্তি হয়ে মোটেই ভুল করিনি। বরং এই বিভাগে পড়ার কারণে বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্যের সঙ্গে যেমন পরিচিতি লাভ হয়েছে তেমনি বাঙালীর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, কালীদাস, শ্রী চৈতন্যদেব, শ্রী চন্ডীদাস, এদের সঙ্গে যেমন পরিচয় হয়েছে, তেমনি পরিচয় হয়েছে রোমাবেলা, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, ইমরুল কায়েসের সঙ্গে। কতটুকু তাদের কাছ থেকে আহরণ করতে পেরেছি সেটা বড় কথা নয়। সেই যে অর্ধশতাব্দী আগে রবীন্দ্রনাথ থেকে শিখে ছিলাম : ‘মনে রে আজি কহ যে ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লহ সহজে’ সেই যে মনের মধ্যে গেঁথে গেল আজও কখনও কখনও মনের অজান্তে চর্চা হয়ে যায়। আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হচ্ছে দেশের প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান কে। (আমার বাবার মামাতো ভাই) যখন দ্বন্দ্বে ছিলাম বাংলায় ভর্তি হব কিনা তখন তিনি বলেছিলেন ‘বাংলায় ভর্তি হও ঠকবে না’। ইংরেজীটা ঘরে বসে শিখে নিও। আজ মনে হচ্ছে ঠকিনি। চাচাকে আল্লাহ দীর্ঘজীবী করুন। স্যারদের প্রায় সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন। তখন ক্যাম্পাসে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান। সকালে হল থেকে ক্যাম্পাসে পা রাখতেই মিছিলের সামনে পড়তে হয়। দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে কোনরকমে এ্যাটেনডেন্স দিয়ে মিছিলে চলে যেতাম। স্যারেরা দেখতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। অর্থাৎ স্যারেরা চাইতেন আমরা মিছিলে যোগ দেই, গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে মিলিটারি আইয়ুবের মসনদ তছনছ করে দেই এবং বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনি। যে মানুষ বাঙালীর জন্য নিজস্ব একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রেখে লড়ে চলেছেন তাঁর প্রতি স্যারদের সমর্থন থাকা স্বাভাবিক। আজ বলতে পারছি যতটুকু দেশপ্রেম সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। শুরু করেছিলাম আনিসুজ্জামান স্যারকে নিয়ে কিছু লিখব। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ঈর্ষণীয়, যেমন প-িত তেমনি বিশ্লেষণের ক্ষমতা। স্যার যে স্ট্যান্ডার্ডে বাংলা গদ্য লিখতেন পরবর্তীতে তা ২/৩ জনের মধ্যে দেখেছি একজন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক অন্যজন লেখক আহমদ ছফা ও অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ। আজ আমি স্যারের দেশপ্রেম নিয়ে দু’চারটে কথা বলব। ১৪ মে ২০২০-এ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। কিন্তু তারপরও স্যারের এ সময় চলে যাবার কথা ছিল না। সিএমএইচ থেকে বলা হয় স্যারের দেহে করোনাভাইরাসের আলামত পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন জীবিত থাকতে কেন ধরা পড়ল না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব করোনা অদৃশ্য, সঙ্গে সঙ্গে সুপ্ত। এ জন্যই কি ধরা পড়ল না। বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক লেখক হারুন হাবিবের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলল গোটা পৃথিবীটাকেই করোনা ধ্বংস করে দিল। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরাও কোন কিছু বলতে পারছে না। আমরা দু’জন কনটেম্পোরারি। বয়সও স্যারের চেয়ে খুব নিচে নয়। বড় জোর এক দশক প্লাস মাইনাস হবে। আর করোনাও ঘণ্টা বাজিয়ে আসে না। ভাবি, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি করে বলেছিলেন- ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’ এটাই যদি সত্য হতো তাহলে সুরের কবি কেন গাইলেন ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায় তবুও মরণ কেন এখান থেকে দূরে নিয়ে চলে যায়’ অর্থাৎ মৃত্যুর চেয়ে জীবন সুন্দর। তবে হ্যাঁ মৃত্যু এক অজানা সত্য। যে জন তা অনুধাবন করতে পারে সে জন মৃত্যুর ভয় করে না। মৃত্যু অবধারিত জেনেও এগিয়ে যায়। মানুষের পৃথিবী এভাবেই বেঁচে থাকে। ইস্রাফিলের সিঙ্গা ফুকানো পর্যন্ত থাকবে। আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও প্রিয় শিক্ষক। শেখ হাসিনা যখনই কোন জাতীয় অনুষ্ঠানে যেতেন আনিসুজ্জামান স্যার অবধারিতভাবে তার পাশে থাকতেন। স্যার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় মানুষ ছিলেন। জাতির পিতা স্বাধীনতার পর ৭২ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় হাত দেন। আজকের সংবিধানের যে বাংলা ভার্সন তা আনিস স্যারের। যেমন অলংকরণ ছিল হাশেম খানের। আনিস স্যার পেশায় শিক্ষক ছিলেন। একজন শিক্ষককে যতখানি লেখাপড়া জানতে হয় স্যার বোধহয় তার চেয়ে বেশিই করেছিলেন। সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজেই এক সাক্ষাতকারে তার হোমিও ডাক্তার বাবার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন ‘বাবা শিখিয়েছেন সময়ানুবর্তিতা মা সত্যপ্রিয়তা’ এই দুটো জিনিসই আমরা স্যারের মধ্যে দেখেছি। তিনি সময়কে ভালভাবে জীবনে ব্যবহার করেছেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার সম্বন্ধে বলেছেন- ‘তার মতো আরেকজনকে আমরা পাবো না’ সত্যিই তো আরেকজন পাওয়া যাবে বলে আমরাও দেখছি না। তার বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম একুশের গানের রচয়িতা প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী তার মৃত্যুতে যে প্রবন্ধটি রচনা করেছেন তার শিরোনাম ছিল ‘হে বন্ধু বিদায়’ শ্রদ্ধেয় গাফফার ভাই তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় উল্লেখ করেছেন- ‘একাত্তরের বুদ্ধিজীবী নিধনের পর দেশ যখন প্রায় বুদ্ধিজীবীহারা তখন যে ক’জন বুদ্ধিজীবী বুদ্ধি ও বিবেকের সততা রক্ষা করে জাতিকে পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে আনিসুজ্জামান ছিলেন পুরো ভাগে...’ স্যারের জীবনী আলোচনায় জানতে পারি আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের শুরুটাও আন্দোলনের মাঝে। দু’জনই তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। গাফফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের আর আনিছুজ্জামান স্যার জগন্নাথ কলেজের। পাকিস্তানী বর্বর শাসকগোষ্ঠী যখন বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ করল এর প্রতিবাদে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তারই কোন এক রক্তঝরা মুহূর্তে রাজপথে দেখা পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। চিরদিনের বন্ধুত্ব। আনিসুজ্জামান স্যার বাঙালীর প্রতিটি সঙ্কটে সামনের কাতারে থেকে বুদ্ধিবৃত্তির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্বৈরশাসক মিলিটারি আইয়ুবের হাভাতে গবর্নর মোনেম খাঁ যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা রবীন্দ্রনাথের ওপর আঘাত হেনেছিলেন তখনও আনিস স্যার ছিলেন প্রথম কাতারের প্রতিবাদী শিক্ষক। স্যার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। স্যার মুজিবনগর বিপ্লবী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টার দায়িত্বের পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশের শিক্ষকদের সমিতি গঠন করে এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে প্রথম যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় তাতেও তিনি ভূমিকা রাখেন। জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে যে কোন সঙ্কটে জাতি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাড়া দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্যার খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে স্যারের প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে। প্রবন্ধটি আমার কাছেও ছিল কিন্তু খুঁজে পেলাম না। প্রবন্ধটি ছিল ইংরেজী ভাষায় রচিত। স্যার যেমন লিখতেন সুপার বাংলা গদ্য তেমনই ইংরেজী লিখতে ও বলতেন সমভাবে। আমার দেখা যে ক’টি ঘটনা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে তার মধ্যে একটি ঘটনা এ লেখায় উল্লেখ করছি : -১৯৯২ সালের প্রথম দিকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন জোরদার হয় এবং ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারী গণহত্যা নারী নির্যাতন অগ্নিসংযোগ প্রধান সহযোগী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণআদালত বসে। সেই আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন আনিসুজ্জামান স্যার। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, (প্রথম আলো ১৬ মে ২০২০) ‘আমি অভিযোগ উত্থাপন করছি বাংলাদেশের শহীদদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতা-মাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে’ আজ এ পর্যন্তই। সর্বশেষ যে কথাটি বলতে চাই আমরা- তো খুব কাছ থেকে আনিস স্যারের মনীষীকে দেখেছি, ক্লাসে, সেমিনারে কথা শুনেছি, আমাদের পরের জেনারেশন কার কথা শুনবে, সবাই মিলে কাকে স্যার বলে ডাকবে। ঢাকা- ২০ মে ২০২০ লেখক : এমপি, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×