ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিম্ন আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দেয়ার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৭ মার্চ ২০২০

নিম্ন আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দেয়ার উদ্যোগ

ওয়োজেদ হীরা ॥ জমির মিয়া রাজধানীতে মালামাল টানেন। ভ্যানের উপর ফ্যাকাশে মুখে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছেন কেউ ভাড়া নিতে এলো কিনা। কাউকে দেখলেই যেন একটু আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু না পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও এখন কেউ মাল টানার জন্য ভ্যান নিচ্ছে না। কিছুক্ষণ বসে থেকে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি, মাঝে মধ্যে অন্য ভ্যানচালকদের সঙ্গে লুডু খেলেন। যদিও খেলার সঙ্গিও এখন কম। বড় শহর ঢাকায় করোনাভাইরাসের আতঙ্কে জনমানব শূন্য হয়ে অনেকটাই খাঁ খাঁ করছে। আর অদৃশ্য ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে জমির মিয়াদের জীবনের উপরও। রাজধানীসহ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অনেকটাই বেকার। কাজ নেই, আয়ও নেই। এর মধ্যেই টানা ১০ দিন সরকারী সাধারণ ছুটি। কি হবে সামনের দিনগুলোতে তা ভাবতেই কারও চোখে গড়ায় নোনা জল। তবে নিম্ন আয়ের মানুষদের বিষয়ে চিন্তা আছে বলে জানাচ্ছে সরকার। বিনা পয়সায় খাবার দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজাধানীতে মানুষ কমে গেছে। তখন থেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ তথা, রিক্সা ও অটোরিক্সাচালক, হকার, গণপরিবহনের শ্রমিক, বিভিন্ন মালামাল টানার চালক, কুলি, দিনমজুরদের আয় কমেছে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে মানুষের স্রোত ছুটে বাড়ির পথে। তখন থেকে আয় একেবারেই নেই। অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ ইতোমধ্যেই গ্রামে ফিরেছেন। যারা ফিরে যায়নি তারা আশা নিয়ে বসে আছেন রাজধানীতে কেননা, গ্রামে ফিরে কোন কিছুই করার নেই। তাই রাজধানীতেই যদি কিছু করা যায় কিংবা সুযোগ হয় সে আশা তাদের। ইতোমধ্যে বাসাবাড়িতে কাজ করা গৃহকর্মীদের অনেকেই ছুটি দিয়েছেন। কেউ কেউ বেতন দিয়ে ছুটি দিয়েছেন কেউ বেতনের সঙ্গে দিয়েছেন কিছু খাবারও। তবে এই ধরনের পরিস্থিতি কতদিন থাকে সেটি নিয়ে চিন্তা রয়েছে গৃহকর্মীদের মধ্যেও। লালমনিরহাটের বাসিন্দা আজম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাড়িত গিয়া কি করুম, যে ক’দিন রিক্সা চালান যায়। পরে গেরেজে থাকুম। এখন আয় একেবারেই নেই।’ ফার্মগেটে এক লেগুনা চালক বলেন, মানুষ নাই যাত্রীও নাই আমাদের গাড়িও অনেক কম। রাজশাহীর রিক্সাচালক সবুজ আক্ষেপের সুরে বলেন, রাস্তায় যাত্রী নাই। এক সপ্তাহ আগেও আধাবেলা রিক্সা চালালে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হতো। এখন এক শ’ও হতে চায় না। জমার টাকা দেয়ার পর নিজের খাবারের টাকাই থাকে না। ৫০ টাকার ভাড়া ২৫-৩০ টাকায় যেতে চাই। তারপরেও যাত্রী নাই। এভাবে চলতে থাকলে বাড়ি যেতে পারব কিনা জানি না। না গিয়েওতো উপায় দেখছি না। এদিকে যারা সিএনজি চালায় তারাও ভাল নেই। অন্যসময় মিটারে যেতেই চায় না এখন যাওয়ার আগেই মিটারে যেতে চাচ্ছে তবে যাত্রী নেই। খালেদ মিয়া নামের সিএনজিচালক বলেন, প্রতিদিনই একটু আশা নিয়া বের হই, যাত্রী কখনও একটু পাই, কখনও জমা খরচ উঠে না। সামনের দিনে আর চালন যাবে বলে মনে হয় না। এদিকে দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের কাজ নেই বললেই চলে। একমাত্র নিত্যপণ্যের যে বাজারগুলো সেসব এলাকা দিনমজুরদের কিছুটা কাজ থাকলেও তা এখন কমে গেছে। অন্যান্য পেশায় যারা কাজ করেন তারা একেবারে বেকার। বিশেষ করে ফার্নিচার, গ্লাস, সিরামিক, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি কাজে যারা দিনমজুর বা দোকানের মালামাল বহন করেন এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় তারা একেবারেই বেকার। এদিকে দেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন করোনাভাইরাসের মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র মানুষ। আর এই দরিদ্রমানুষদের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলছেন তারা। এই ভাইরাসে দেশের দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারকে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে জানিয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, স্বল্পমূল্যে সরকারীভাবে পণ্য সরবারহ করতে খোলাবাজারে (ওএমএস) কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যেসব অঞ্চলে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি বসবাস করে যেখানে ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যাতে করে তারা কম মূল্যে সহজে নিত্যপণ্য কিনতে পারে। আগামী দুই মাসের জন্য জরুরীভাবে এ কার্যক্রমা চালু করা দরকার। জরুরী ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন সিপিডি। এর আগে জনকণ্ঠকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, আমি বলব কঠিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে গরিব মানুষ। নিম্নবিত্ত মানুষ। মধ্যবিত্ত মানুষও পরবে যদি এর আকার বাড়তে থাকে তবে সেটা আরাও পরে। যারা দিন আনে দিন খায় যদি দিনে আনার বিষয়টি মানে রোজগার না হয় তাহলে তো খাওয়ার সুযোগ নেই আর এর মধ্যে যদি দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে তাহলে আরও নেই। এরমধ্যে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি দুশ্চিন্তা তো আছেই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়াম্যান ড. মোঃ আইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, এই করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা দিন আনে দিন খায়। এই শ্রেণীর মানুষ অনেক। রিক্সাওয়ালা, সবজিওয়ালা বা যাদের নিম্ন আয় তাদের এখন থেকেই অল্প মূল্যে কি করে নিত্যপণ্য দেয়া যায় সেটিও দরকার। এদিকে, জানা গেছে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষদের কিভাবে সেবা দেয়া যায় তা নিয়ে কাজ করছে সরকার। ইতোমধ্যেই জনগণের স্বার্থে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে তিনটি নির্দেশনায় নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ে। গত সোমবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত শুনিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন আয়ের কোন ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম হয়, তাহলে সরকারের যে ঘরে ফেরার কর্মসূচী রয়েছে, তার অধীনে সহায়তা করার ঘোষণা করা হচ্ছে। এ জন্য জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন। সরকার ভাসানচরে এক লাখ লোকের আবাসন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যারা আগ্রহী তারা সেখানে যেতে পারবেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন। করোনাভাইরাসজনিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় ও অন্নসংস্থানের অসুবিধা নিরসনের জন্য জেলা প্রশাসকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ শাহ্ কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ ইতোমধ্যেই ডিসিদের কাছে পৌঁছে গেছে। আমরা ৮ কোটি টাকা ২৮ হাজার ৭১৭ টন চাল দিয়েছি। যা গরিব, নিম্ন আয়ের মানুষ বিনা পয়সায় পাবে। এর আতওয়া সারাদেশেই একটি তালিকা রয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, কোন এলাকায় কে গরিব মানুষ, অসহায় মানুষ আমাদের সেই তালিকা আছে সেই তালিকা অনুযায়ী ৯ লাখ মানুষ এর সুবিধা পাবেন চাহিদার ভিত্তিতে এলাকার জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। নগদ টাকা দেয়া হয়েছে যাতে করে চালের সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্য পণ্য কিনে দেয়া হয় বলেন তিনি। এদিকে, বুধবারও অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ বেকার হয়ে গ্রামের পথ ধরেছেন। যাদের অনেকেই অল্প টাকায় পণ্যবাহী গাড়িতে উঠেছেন। কারওয়ান বাজার থেকে ট্রাকে বগুড়ার জন্য গাড়িতে উঠেন একদল শ্রমিক। যারা অধিকাংশই দিনমজুরের কাজ করেন। তাদের একজন বলেন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও এখন আর কাজ নাই। গ্রামে গিয়া দেখি ডাল ভাত খাওয়া যায় কিনা। নয় ঢাকায় না খাইয়া মরুম। রাজধানীতে বুধবারও যে সব অল্প স্বল্প গণপরিবহন চলাচল করছে সেখানে যাত্রী হাতে গোনা কয়েকজন। আয়াত পরিবহনের এক শ্রমিক জানান, করোনা আতঙ্কের কারণে কমসংখ্যক মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। গাড়িও কমে গেছে। গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক শ্রমিকরা বলছেন, রাস্তায় গণপরিবহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় শত শত পরিবহন শ্রমিক বেকার। অনেকেই কাজ নেই তাই বাড়ি গেছেন। অনেকেই ঢাকায় আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে অনেক বাসার গৃহপরিচারিকাদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লালমাটিয়া, ধানম-ি, শংকর, মোহাম্মদপুর, পল্টন, মালিবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অনেক বাসায় এখন নিজেরা কাজ করছে। বাসার লোকজন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না ফলে গৃহপরিচারিকাদের আপাদত ছুটি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী চালু আছে। বর্তমানে সারাদেশে ৫০ লাখ কার্ডধারী নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি যেটা ঢাকার বাহিরে সেই কর্মসূচী চালু রয়েছে। ঢাকায় খোলাবাজার ব্যবস্থার (ওএমএস) মাধ্যমে চাল ও আটা বিক্রি সেটিও চালু আছে। করোনায় নিয়ে এখনও কোন বরাদ্দ বা সিদ্ধান্ত নেই তবে হওয়া মাত্র আমরা সেটা অনুসরণ করব। করোনা নিয়ে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি আছে সামাজিক নিরাপত্তা নামে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের স্টকও ভাল আছে। আমরা বন্ধের মধ্যেই ঢাকায় ওএমএস চালিয়ে যাচ্ছি এবং জেলা পর্যায়ে ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব দুটিই চলবে।
×