ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩৫ বছর ধরে ভাগ্য বদলের চেষ্টা

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঘানির খাঁটি তেল যাচ্ছে বিদেশে

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৫ মার্চ ২০২০

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঘানির খাঁটি তেল যাচ্ছে বিদেশে

শেখ আব্দুল আওয়াল ও মজিবুর রহমান ফয়সাল ॥ গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কলুর ঘানি আজ আর নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নিত্য নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের প্রতিটি কাজ হচ্ছে সহজ থেকে সহজতর। উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ ও সময় তথা উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে বিশ^ব্যাপী এরই ছোঁয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দিন দিন বিদ্যুত উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ছে। ব্যবহারের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় গ্রাম হতে গ্রামান্তরে। আধুনিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া গ্রাম বাংলা অনেক ঐতিহ্য ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি একটি বিলুপ্ত প্রায় শিল্প তেলের ঘানি বা খাঁটি সরিষার ঘানি তেল উৎপাদন শিল্প। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কলুর তেলের ঘানি শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে, এতে করে কলুরা আজ বাপ দাদার ঐতিহ্য পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায় । আবার কেউ কেউ মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেউ বা আবার এ পেশা ধরে রেখেছে গরু বা ঘোড়া না থাকায় নিজেদের গতর খাটিয়ে। তেমনি এক দম্পত্তি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ছালুয়াপাড়া গ্রামের কলুর ঘানির মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় গত ৩৫ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলে গরুর জোয়াল বুকে ঠেকিয়ে ঘানি টেনে সরিষা থেকে তেল বের করছে দুলাল ও রাজিয়া। ছালুয়াপাড়া গ্রামের দুলাল উদ্দিন রাজিয়া খাতুন কাক ডাকা ভোরে শুরু করে তাদের প্রতিদিনের সংগ্রামী জীবনের ঘানি টানা। প্রতিদিনের মতো ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত চলে তাদের ঘানি টানা। দুলাল বলেন, জন্মের পর থেকেই দাদার সঙ্গে ঘানি টেনে বড় হয়েছি কিন্তু অভাব দূর করতে পারিনি, সম্বল বলতে ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই। স্বামী স্ত্রী মিলে ঘানি টেনে চালাচ্ছি জীবন। এই অভাবে সরকার এতকিছু দিচ্ছে তবু আমরা কিছুই পাই না। চেয়ারম্যান ও মেম্বাররাও কিছুই দেয় না, ঘানি টেনে সরিষা থেকে তেল ভাঙ্গিয়ে সেই তেল বিক্রি করে জীবন চলে আমার। তেল নিজ এলাকা ছাড়াও ঢাকাসহ বিদেশেও যায়। প্রতি ১ লিটার তেল ২০০ টাকা বিক্রি করতে পারি। আজ ১টি গরু থাকলে হয়তো তেলের উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো যেত। শেষ বয়সে এসে নিজের বুকের সঙ্গে গরুর জোয়াল লাগিয়ে ঘানি টেনে জীবন চালাচ্ছি। দুলাল আরও বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার আবেদন ১টি গরু হলে মৃত্যুর আগে হয়তো একটু সুখের মুখ দেখতে পাব। দুলালের স্ত্রী রাজিয়া খাতুন জানান, চল্লিশ বছর বিয়ে হয়েছে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে ঘানি টানছি। দুই ছেলে মেয়ের সংসারে মেয়েকে বিয়ে দিলেও ঘানি টানার পয়সা থেকেই যোগান দিতে হচ্ছে তাকেই। ছেলেটা কিছুদিন আগে পোশাক শ্রমিক হিসেবে ঢাকা একটি কোম্পানিতে অল্প বেতনের চাকরি করছে, ঘানি তেল বিক্রি করেই চলছে আমার সংসার। অভাব যেন পিছু ছাড়ছে না তাই সরকার এবং বিত্তবানদের কাছে আবেদন কেউ যদি একটি গরু দিয়ে সহায়তা করেন তাহলে হয়তো ৩৫ বছর পর হলেও একটু সুখের মুখ দেখতে পাব। মহেশকুঁড়া আফতাব উদ্দিন দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ফজলুল হক বলেন, দুলাল ও তার স্ত্রী ৩৫/৪০ বছর যাবত নিজেদের গতর খাটিয়ে খাঁটি সরিষার তেল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে। একটি গরুর অভাবে বৃদ্ধ বয়সে এসেও নিজেরাই গরুর কাজ করছে। আমি আশা করব বিত্তবান এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে যেন দুলাল রাজিয়ার সহায়তায় আগাইয়া আসে। প্রতিটি ঘানিকে ‘গাছ’ বলা হয়। গাছে একটি বিশেষ আকৃতি ছিদ্রের ভেতর দিয়ে তেল পড়ে এবং তা একটি বাটি ও পাতিলে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি গাছে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙ্গা যায়। পাঁচ কেজি সরিষা থেকে তেল উৎপাদন করা হয় দেড় থেকে পৌনে দুই কেজির মতো। পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙ্গতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা, দিনে একটি ঘানি থেকে সাড়ে তিন থেকে চার কেজি তেল ভাঙ্গা সম্ভব হয়। ছালুয়াগ্রামের বাসিন্দা মজনু মিয়া বলেন, ময়মনসিংহ, ঢাকা, টাঙ্গাইল সহ বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দুলালের ঘানির তেল সৌদি আরব, দুবাইও যায়, ঘানি তেলের ঝাঁঝ বলে দেয় এটি খাঁটি সরিষার তেল। শিশুদের শরীরে মালিশ করার জন্য ক্রেতারা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। এই ঘানির মালিকদের বলা হয় (কলু) গরু না থাকায় দুলালের পরিবারে ঘানি চালানো খুবই কঠিন হয়ে পরেছে এতে শ্রম, সময়, অর্থ ব্যয় হয় এ কারণে অনেকেরই ইচ্ছা থাকলেও আর ঘানি চালাতে চায় না অনেকেই অন্য পেশার দিকে ঝুঁকেছেন।
×