ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

শেখ মুজিব ॥ বাঙালীর ভাষারাষ্ট্রের পিতা

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 শেখ মুজিব ॥ বাঙালীর ভাষারাষ্ট্রের পিতা

॥ পাঁচ ॥ বায়ান্নো সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকার প্রেক্ষিতে অনেকেই ভাষা আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা কথা বলেন। তিনি তখন জেলে থেকে যে ভূমিকা পালন করেন সেটির বাাইরেও জেলের বাইরে এসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য কি ভূমিকা পালন করেন সেটিও আমাদের জানা দরকার। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ধর্মঘটের ঘোষণায় মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দমন পীড়ন বাড়িয়ে দেয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শেখ মুজিবকে চিকিৎসা না করে ঢাকা জেলে প্রেরণ করা হয়। শেখ মুজিব ৬-২-৫২ তারিখ তাঁর পিতার কাছে জেল থেকে চিরকুটে লিখেছেন ‘Heart চিকিৎসা কিছুই হয় নাই। ভয়ের কোন কারণ নাই। খোদার রহমতে আমি মরবো না। Heart চিকিৎসা না করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কারণ সদাশয় সরকার বাহাদুরের নাকি যথেষ্ট টাকা খরচ হয় আমার জন্য। এদের কাছে বিচার চাওয়া আর সাপের দাঁত এর কাছে মধু আশা করা একই কথা।’ শামসুল হুদা হারুন, বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকার গ্রহণের সময় শেখ মুজিব নিজে এই চিরকুটের কথা তাকে জানান; শাসকদের প্রাণে কোন দয়ামায়া আছে বলে মনে হয় না। কারাবন্দী শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমদ ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বরাবরে তাদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট করার হুমকি দিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকার কি পরিমাণ আতঙ্কগ্রস্ত থাকতো শেখ মুজিবকে নিয়ে তার জন্য নিচের উদ্ধৃতাংশ দ্রষ্টব্য: ফরিদপুর জেলে পৌঁছেই তারা দু’জন অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট’ শিরোনামে নিম্নলিখিত প্রচারপত্র সারাদেশে বিলি করা হয় : শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট : বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশ যে নিরাপত্তা বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিয়াছেন। আরও প্রকাশ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আজম জনাব নুরুল আমিন সমীপে এক স্মারকলিপি পেশ করেন। ইহাতে তাহাদের নিরাপত্তা আইনানুসারে আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং নীতিবিরুদ্ধ। কারণ প্রকাশ্য আদালতের বিচারে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ্য কোন অভিযোগ নিতে সরকার সক্ষম হন নাই। তাহারা পাকিস্তান সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যয়ে তাহাদের অপার ত্যাগ ও কাজের উল্লেখ করেন... সরকার যদি তাহাদিগকে সমস্ত নিরাপত্তা বন্দীসহ ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্ত না করেন তবে তাহারা প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে আমরণ অনশন করিবেন উপযুক্ত প্রচারপত্রের ওপর ভিত্তি করে ‘শেখ মুজিবের অনশন ধর্মঘট’ নামে খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করার হুমকি দিয়েছিলেন। তারা যাতে অনশন শুরু করতে না পারেন সেজন্য নুরুল আমিন সরকার তাদেরকে ঢাকা জেল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করেন। ফলে তারা ঐদিন অনশন শুরু করতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদ ১৮ তারিখ সকাল থেকে ফরিদপুর জেলে অনশন শুরু করেন। শেখ মজিব এবং মহিউদ্দিনের অনশন নিয়ে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে আনোয়ারা বেগম, বেশ জোরালো বক্তব্য রাখেন। শেখ মুজিবের কারাজীবন স্বাস্থ্যের অবনতি তার প্রতি অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কিত বিষয় জাতির বিবেককে বিশেষ করে বঙ্গীয় পরিষদকে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয় তার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জনগণের উদ্যোগ জাতীয় দাবি হয়ে ওঠে। উত্তেজনা চলতে থাকে। ২৩ ও ২৪ তারিখও সরকারী দমননীতি অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা ব্যক্ত করে গবর্নর ২৪ তারিখ আইন পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রদেরকে হল ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করেন। অন্যদিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি গণদাবির মুখে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সরকারী এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : Security prisoner Sk. Mujibur Rahman broke his fast on receipt of the Govt. order for his release on the afternoon of 25.2.52. He was let off from the jail on the morning of 27.2.52. জেল থেকে মুক্তি দিলেও শেখ মুজিবকে গোয়েন্দা পুলিশ সার্বক্ষণিক নজরে রাখে। তিনি কোথায়, কখন, কার সঙ্গে দেখা করছেন, কি করছেন প্রভৃতি গোপনে নজর রাখে। এসব গোপন নজরদারির বিবরণী কর্তব্যরত গোয়েন্দা পুলিশ তাঁর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনার জন্য নথিতে লিপিবদ্ধ করে রাখত। এ ব্যাপারে পূর্ববাংলার গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এ. কে.এম হাফিজউদ্দীন ফরিদপুরের সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশকে পয়লা মার্চ, ১৯৫২ তারিখে টেলিগ্রাম করে জানান : Please keep continuous watch on Sk. Mujibur Rahman and if he indulges again in prejudicial activities he should be arrested. প্রায় আড়াই বছর শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জেলে বন্দী থাকার ফলে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাইয়া জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাহার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করিতেছেন। তাঁহার স্বাস্থ্যের অবস্থা এখনো উদ্বেগজনক। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালনা ও ধরপাকড়ের খবরে তিনি অতিশয় মর্মাহত হইয়াছেন। তিনি শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছেন। জনাব রহমান শীঘ্রই চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসিবেন। আড়াই বছর একটানা কারাবাসের ফলে তাঁহার স্বাস্থ্য একদম ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।’ তাছাড়া তিনি হার্টের সমস্যায়ও ভুগছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বেশ কিছুদিন রক্ত আমাশায় ভুগেছেন। (পরিশিষ্ট ৩২ : পূর্ববাংলার ফরিদপুর জেলা কারাগার থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ইংরেজীতে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি। অবশ্য পাকিস্তানী গোয়েন্দা দফতর সে চিঠি জব্দ করে)। আসলে তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে এক মাস ২০ দিন অবস্থান করতে হয়েছে। সরকারী নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি অসুস্থ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট লিখিত পত্রে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের জনবিরোধী কর্মকান্ড, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা ও সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা এবং অবিলম্বে ঢাকায় আসার জন্য উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিব কর্তৃক লিখিত অথবা মুজিবকে লিখিত পত্রসমূহ গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে কঠোরভাবে সেন্সর করা হতো। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নিকট ২৮.৩.৫২ তারিখে লিখিত শেখ মুজিবের এরূপ একটি চিঠি (চিঠিটি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আটক করেছিল।) থেকে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে যে, শেখ মুজিব শীঘ্রই ঢাকায় আসছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আমি অনেক ভাল। আমার শরীর একটা রোগগৃহ। সে যা হোক আমি অবশ্যই ১৬ তারিখ অথবা তার পূর্বে ঢাকা পৌঁছিব। আমার পুরোপুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।’ এই চিঠি ঢাকার জি-পি-ও থেকে বাজেয়াফত করার পরপরই গোয়েন্দা দফতর তৎপর হয়ে ওঠে। শেখ মুজিব ১৯ এপ্রিল, ১৯৫২ রওনা হয়ে তিন দিনের মাথায় ২১ এপ্রিল, ১৯৫২ ঢাকায় পৌঁছেন। ফরিদপুর থেকে যাত্রা করার সময় থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ঢাকা পর্যন্ত কিভাবে গোপনে অনুসরণ করে তা ফরিদপুরের একজন ডি-আই-বি অফিসারের রিপোর্ট থেকে জানা যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি কত কঠোর ছিল, তার একটি নমুনা উপরোক্ত রিপোর্ট। এ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ব্যক্তি অথবা ভয়ানক শত্রু। ফরিদপুরের একজন ডি-আই-বি অফিসারের দৃষ্টি উন্মোচনকারী নমুনা : ‘আমি রিপোর্ট করছি যে, সন্দেহভাজন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯-৪-৫২ তারিখ বেলা ১১ টায় স্টিমার যোগে গোপালগঞ্জ (ফরিদপুর) থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আমি গোপালগঞ্জের ডি-আই-ওর নির্দেশক্রমে তাকে গোপনে অনুসরণ করি। তিনি ২১-৪-৫২ তারিখ প্রায় সকাল দশটায় নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে পৌঁছেন। তিনি ই.বি.ডি.২৯২০ নম্বর টেক্সিযোগে স্থান ত্যাগ করেন। আমি ট্যাক্সিযোগে গোপনে তাকে ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পর্যন্ত অনুসরণ করি। রাত প্রায় ১১ টায় তিনি মোগলটুলী (ঢাকা) ১৫০ নম্বর (বাড়িতে) প্রবেশ করেন। তখন আমি ২২-৪-৫২ তারিখ সকাল ৭টা পর্যন্ত গোপন নজরদারি করি, সকাল প্রায় ৭টার সময় আমি বিষয়টি যথারীতি আই-বি অফিসে জানানোর জন্য ঐ স্থান ত্যাগ করি।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেখ মুজিবকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সবসময়ই কি রকম চোখে চোখে রাখত তার প্রমাণ ঐ গোয়েন্দা প্রতিবেদন। ঢাকায় শেখ সাহেব ২৩ এপ্রিল, ১৯৫২ আতাউর রহমান খানের ২৫ নম্বর সোয়ারী ঘাটস্থ বাড়িতে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভায় যোগদান করেন। সরকারী নথিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ এপ্রিল (১৯৫২) ঢাকা বার এ্যাসোসিয়েশনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সম্মেলনে উপস্থিত হন এবং আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সভায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গণভোটের প্রস্তাব করলে তা সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য যে, নজরদারি পুলিশ শেখ মুজিবের ভাষণের যে অংশটি উল্লেখ করেনি তা ছিল ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশিম ও অন্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই। ভাষা চাই... মুসলিম লীগ সরকার আর ‘মর্নিং নিউজ’ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’ ঢাকা ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক
×