ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লড়াকু ইমন, অদম্য আকবর

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

লড়াকু ইমন, অদম্য আকবর

জিএম মোস্তফা ॥ অবশেষে স্বপ্নপূরণ হলো। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল বাংলাদেশ। রবিবার রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে হট ফেবারিট ভারতকে হারিয়ে স্বপ্নের শিরোপায় চুমো খেলেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সাকিব-মাশরাফি-তামিমরা যা পারেননি এবার সেটাই করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের যুবারা। দক্ষিণ আফ্রিকার পোচেসস্ট্রমে অসাধারণ পারফর্ম করে যেন গোটা ক্রিকেট বিশ্বকেই জানিয়ে দিল টাইগার ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা। এর পেছনে গোটা দলের ভূমিকাই প্রশংসনীয়। তবে ফাইনাল জয়ের নায়কের ভূমিকায় ছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন ও দলপতি আকবর আলী। ভারতের ছুড়ে দেয়া ১৭৭ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে একটা সময় ১০২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। চাপের মুখে পড়ে যায় মাশরাফি-মুশফিকদের উত্তরসূরিরা। কিন্তু তারপরও দলকে টেনে নিয়ে জয় উপহার দেন পারভেজ হোসেন ইমন ও ক্যাপ্টেন আকবর আলী। স্কোরবোর্ডে ইমনের রান ৪৭। তবে পরিস্থিতির বিচারে তার ওই ইনিংসের দাম সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি। ইমন সেই সময়ে রুখে না দাঁড়ালে যে ম্যাচটা বের করে আনাটাই কঠিন হয়ে যেত বাংলাদেশের। অথচ, এক সময় মনে হয়েছিল, ফাইনালে আর ব্যাট হাতে নামতেই পারবেন না তিনি। ভারতের রান তাড়া করার সময়ে হঠাৎ করেই পায়ের পেশিতে টান ধরায় তখন সোজা হয়ে দাঁড়ানোটাই কষ্টকর হয়ে উঠে তার পক্ষে। তানজিদ হাসান আউট হয়ে ফিরতেই ক্যামেরায় ধরা পড়ে মাঠে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন। বাধ্য হয়েই ফিরে যেতে হয় ড্রেসিংরুমে। কিন্তু তাসের ঘরের মতো যখন ভেঙ্গে পড়ে বাংলাদেশ, তখন আর স্থির থাকতে পারেননি বাংলাদেশের বাঁ হাতি ওপেনার। ষষ্ঠ উইকেট যাওয়ার পর ওষুধ খেয়ে সটান নেমে পড়েন অধিনায়ক আকবর আলিকে সঙ্গ দিতে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যান। ইমন যখন আউট হলেন, তখন বাংলাদেশ জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করে দিয়েছে। তার ফেলে আসা কাজটা শেষ করেন আকবর ও রাকিবুল। প্রথমবার যুব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে তিনি ভুলেছেন পায়ের প্রবল যন্ত্রণা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ইমন বলেন, ‘এটাই আমার জীবনের সেরা ইনিংস। পঞ্চাশ করতে পারিনি। তবে তাতে কোন আক্ষেপ নেই। দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পেছনে আমারও যে অবদান রয়েছে, তা ভেবে খুব ভাল লাগছে।’ শারীরিক যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে দলের জন্য নিজের সেরাটা দেয়ার বহু নজির রয়েছে ক্রিকেটে। ইমনের ইনিংসটাও দীর্ঘদিন নিশ্চিত মনে রাখবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ফাইনালের এই কঠিন সময়ের স্মৃতিচারণ করে ইমন বলেন, ‘আমি যখন ১৫ রানে ব্যাট করছি, তখনই টের পাচ্ছিলাম যন্ত্রণা হচ্ছে। ২৫ রান করার পর আর টানতে পারলাম না। মাঠেই শুয়ে পড়ি। ভাবলাম আধঘণ্টা যদি বিশ্রাম নেই, তা হলে হয়তো পরে ব্যাট করতে পারব। এ দিকে একের পর এক উইকেট যখন যাচ্ছে, তখন আর ডাগ আউটে বসে থাকতে পারলাম না। নেমেই পড়লাম ব্যাট হাতে।’ তার পরের দৃশ্যটা সবারই দেখা! এদিকে, আকবর আলীর গল্পটাও বীরত্বের। অধরা এক বিশ্বকাপ জয়ের মূল নায়ক এই অধিনায়ক। কত আবেগ বুকে চেপে মানুষকে কাজ করে যেতে হয়। খেলার মাঠে সেটি আরও রূঢ় সত্য। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ চলাকালে পিতাকে হারিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর। বাবার শেষকৃত্য শেষে মাঠে ফিরেই করেছিলেন সেঞ্চুরি। পিতাকে উৎসর্গ করেছিলেন সেটি। তেমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ দলের এই অধিনায়ক। তবে আকবর আলী জিতলেন স্বপ্নের বিশ্বকাপ! গত ২২ জানুয়ারি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান আকবরের একমাত্র বড় বোন। প্রিয়জন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করেই ১৯ দিনের মাথায় দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসালেন আকবর আলী। ভাই ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে গেলেই জায়নামাজে বসে থাকতেন বড় বোন। দুই হাত তুলে দোয়া করতেন ছোট ভাইয়ের জন্য। ভাই যেন ভাল খেলে, সুস্থ শরীর আর জয় নিয়ে ফিরতে পারে। কিন্তু আকবর আলীর এমন বীরত্বগাথা দেখে যেতে পারেননি বোন খাদিজা খাতুন। ১৮ জানুয়ারি অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আকবরদের প্রথম ম্যাচটাও দেখেছিলেন খাদিজা। কিন্তু ২২ জানুয়ারি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। এত বড় শোকের কথা আকবরকে জানানোর সাহস পায়নি কেউ। খবরটা প্রথমে চেপেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক তা জেনে যান আকবর। ২৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ার পরপরই আকবর ফোন দিয়েছিলেন তার মেজ ভাইকে। বলেছিলেন, আপার মৃত্যু সংবাদটা কেন আমার কাছে চেপে গেলেন আপনারা? এই প্রশ্নের উত্তর হয়? আকবরের বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা ছেলের কৃতিত্বে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। মেয়ে হারানো শোকও কমছে না। তিনি যে বাবা। কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শেষ চার নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। সেমিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিতে স্বপ্নের ফাইনাল। ফাইনালেও জয়। বাংলাদেশকে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিতে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন আকবর। বোনের মৃত্যুর শোক বুকে নিয়েই ম্যাচগুলো খেলেছেন আকবর। এই আকবর যে অন্য ধাতুতে গড়া। শোককে শক্তিতে পরিণত করার কথা মুখেই বলা যায়। আকবর তা করে দেখালেন। আকবরের মা সাহিদা আখতার চোখে জল নিয়েই বলেছেন, ‘জিতে দেশে ফেরার পণ করে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল ছেলে। ওর অদম্য ইচ্ছে। যা পূর্ণ হয়েছে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে ও। এই জয় পুরো দেশবাসীর।’ আকবরের বাবা মোস্তাফা কান্না থামাতে পারছিলেন না কথা বলতে গিয়ে। তবে তিনি বলেন, ‘কান্না থামাতে পারছি না। এ কান্না খুশির কান্না। আকবর পুরো বিশ্বের সামনে গর্বিত করেছে দেশকে। ও দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসবে, এমন ইচ্ছে ছিল ওর। মনের জোরে সেই ইচ্ছাপূরণ করেছে আকবর।’
×