ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সোমবার আরও তিন ছাত্রী ধর্ষিত

গণধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

গণধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়

নিয়াজ আহমেদ ॥ একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে তোড়পাড় সৃষ্টি করেছে। রেপিস্টরা নির্মাণাধীন কোন ভবনে, বাস ঝোপ জঙ্গল কিংবা, নিরিবিলি স্থানে তরুণীদের ধরে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করছে। ধর্ষণের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর হয়ে ওঠে। সোমবারও নরপশুদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছে নরসিংদী, সাভার ও রূপগঞ্জে তিন স্কুলছাত্রী। এদের মধ্যে দুজনকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের বেডে ওরা কষ্ট ও বেদনায় ছটফট করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, তিন ধর্ষণের ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব রেপিস্ট কিশোর দিনরাত আড্ডা দেয় এবং স্কুলছাত্রী ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে। এসব দুর্বৃত্ত ইয়াবা, ফেনসিডিল মদ, বিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাদক কারবারে জড়িত। এরা শেল্টার পায় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের। গডফাদারদের রাশ টেনে না ধরলে এর প্রতিকার সম্ভব নয় বলে আইন বিশেষজ্ঞ ও সমাজপতিরা মনে করেন। সোমবার ঢাকা মেডিক্যালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন, নরসিংদীর ধর্ষিত স্কুলছাত্রী সাভারের ৫ বছরের মাদ্রাসা ছাত্রীর অবস্থা গুরুতর। তাদের ওসিসিতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওসিসির সমন্বয়ক ডাঃ বিলকিস বেগম জানান, সকালে নরসিংদী ধর্ষিতাকে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে তার পরিবার। তখনও তার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। পরে চারটি সেলাই দেয়া হয়। তার অবস্থা এখনও গুরুতর। সাভারের ৫ বছরের মাদ্রাসাছাত্রীর অবস্থাও গুরুতর। তার গোপনাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে, বারবার বমি করছে সে। তাকে ওষুধপথ্য দেয়া হচ্ছে। পুলিশ জানায়, নরসিংদীর স্কুলছাত্রীর বাবা জানান, রবিবার সন্ধ্যায় বাসার পাশের একটি দোকানে মেয়েটি সদাই কিনতে যাচ্ছিল। পথে আল-আমিন (৩৫) নামে এক দুর্বৃত্ত মুখ চেপে ধরে তাকে পাশের বাঁশঝাড়ে নিয়ে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা শিশুটিকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতাল নিয়ে যায়। সেখান থেকে ভোরে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে পরে পুলিশ রাতেই পলাশ থানার মাঝেরচড় থেকে ধর্ষক আল-আমিনকে গ্রেফতার করে। সে ধর্ষণের কথা স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এদিকে ঢাকার অদূরে সাভারে ৫ বছরের মাদ্রাসার এক স্কুল পড়ুয়া শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ করেছে তার পরিবার। সোমবার বেলা ১১টার দিকে শিশুটিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুটির বাবা অভিযোগ করেন, তারা সাভারে থাকেন। তার মেয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ে। শনিবার বিকেলে বাসার পাশেই মাঠে খেলছিল সে। এরপর সন্ধ্যার পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় দুই ঘণ্টা পর মাঠের পাশেই পাওয়া যায় মেয়েকে। তখন তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হলেও বিষয়টি তখনও কেউ বুঝতে পারেনি। এরপর শিশুটি বারবার বমি করতে থাকলে পরে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরাই জানান, শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়। কে বা কারা এই কাজটি করেছে। তা বলতে পারেননি শিশুটির বাবা। তাই এখনও বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করা হয়নি। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আব্দুল খান জানান, শিশুটিকে সকালে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তার পরিবার। তাকে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল রূপগঞ্জ রূপগঞ্জ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় ৪ জনকে এজাহার নামীয় আসামি করে মামলা হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের আরও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও টায়ার জ¦ালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়। অপরদিকে ঘটনার পরই উপজেলা ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতি ফয়সাল আলম শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ মাসুম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারাব পৌরসভা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবু সুফিয়ানকে বহিষ্কার করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ ঘটনায় ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন ধর্ষণের মেহমান হয়ে এসেছিলেন। যারা ধর্ষণের মেহমান হয়ে এসেছিলেন তাদের বাঁচাতে একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। এজাহার নামীয় আসামি ৪ জনের মধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হলেও আরও ১ জন গ্রেফতার বাকি রয়েছে। এজাহার নামীয় আসামির বাইরে যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের ব্যাপারে থানা পুলিশ রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে। আর ছাত্রলীগের এ সিন্ডিকেটটি ফেনসিডিল, ইয়াবা, মদ, বিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর এদের সেল্টার দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। আর ওই নেতারাই এখন এজাহার নামীয় আসামির বাইরে যারা জড়িত রয়েছে তাদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সিন্ডিকেটটি রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াইহাজার, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকার মাদকের আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে এদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পাচ্ছে না। স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও টায়ার জ¦ালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর দাবি, কোন অপরাধী যেন ছাড় না পায়। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন অপরাধীদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়। মামলার এজাহারে ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীর বাবা উল্লেখ করেন, তার মেয়ে গন্ধর্বপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। গত কয়েকদিন আগে গন্ধর্বপুর এলাকার বাদল মিয়ার ছেলে তৌসিফ তার মেয়ের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে গন্ধর্বপুর স্ট্যান্ডে তার মেয়ের ধারের টাকা ফেরত আনতে যায়। পরে টাকা ফেরত নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তৌসিফ, আফজাল, তারাবো পৌর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান সোহান ও তানভীরসহ অজ্ঞাত ২/৩ জন তার মেয়েকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। পরে রূপসী এলাকার একটি বাড়িতে তারা দুদিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মৌচাক এলাকায় ধর্ষিতাকে ফেলে রেখে ধর্ষণকারীরা পালিয়ে যায়। পরে তার পরিবারের লোকজন তাকে মৌচাক থেকে উদ্ধার করে। পরে ওই শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় উপজেলার গর্ন্ধবপুর এলাকার বাদল মিয়ার ছেলে তৌসিফ, কর্ণগোপ এলাকার মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে আফজাল ও রূপসী প্রধান বাড়ি এলাকার আবুল কালামের ছেলে আবু সুফিয়ান সোহানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজাহার নামীয় আসামি রূপসী এলাকার মৃত কবিরের ছেলে তানভীরকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল হাসান জানান, এজাহার নামীয় আসামি বাকি একজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়া দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও অনেকের নাম আসতে পারে। অপরাধী বা অপরাধীর সেল্টারদাতারা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন। পুলিশের পক্ষ থেকে কোন অপরাধীকে ছাড় দেয়া হবে না। এর আগে ৫ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। এ নিয়ে উত্তাল হয়ে ঢাবি ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও নারীর জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ধর্ষণবিরোধী গণপদযাত্রা করা হয়েছে। পরে ৮ জানুয়ারি এ ঘটনার মূলহোতা রেপিস্ট মজনুকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। রেপিস্ট মজুন ৫ দিনের রিমান্ডে ডিবি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে কামরাঙ্গীরচরে পূর্ব রসুলপুর ৪ নম্বর একটি নির্মাণাধীন ভবনে ধরে নিয়ে ১৩ বছরের মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পাঁচ বন্ধু। ঘটনার পরেরদিন শুক্রবার মেয়েটির মা কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা দায়ের করার পর দুপুরেই হাসান, সিফাত, সবুজ ও রনি এবং ধর্ষিতার সমবয়সী ওই বান্ধবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। এরপর পরদিন শনিবার সকালে ওই মামলার পলাতক অন্যতম আসামি রতনকে ঢাকার সাভার এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। যেস্থানে এসব ঘটনা ঘটেছে এলাকার এসব রেপিস্ট কিশোররা দিন রাত আড্ডা ও স্কুল পড়ুয়া শিশুদের ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করত। এমনকি আর এরা এলাকায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, বিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর এদের সেল্টার দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা। সূত্রগুলো জানায়, কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসূলপুরে নির্মাণাধীন ভবনে ১৩ বছরের কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পাঁচ বন্ধু। এই ৫ বন্ধু তার ক্যাডাররা পূর্বরসূলপুর ১ থেকে ৭ নম্বর অলিগলিতে মাদক কারবারে জড়িত। তারা ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার আস্তাভাজন ক্যাডার। একইদিন রাতে ভাটারায় গণধর্ষিতা ১২ বছরের কিশোরীকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা ফেলে যায় ধর্ষকরা। পরে কুমিল্লা থেকে রাসেল মিয়া (১৮) নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ৯ জানুয়ারি রামপুরায় মুশফিক আলম (৩৮) নামে এক বাবুর্চি দুই কর্মজীবী তরুণীকে করে। পরদিন রামপুরা থানায় মামলা হয়েছে। ধর্ষককে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। বর্তমানে সে কারাগারে।
×