ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুয়েটে ফের ক্ষোভ ॥ এবার শিক্ষকরা বললেন উপাচার্য অনুপযুক্ত

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

বুয়েটে ফের ক্ষোভ ॥ এবার শিক্ষকরা বললেন উপাচার্য অনুপযুক্ত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আবরার হত্যার বিচারে সরকারের নেয়া পদক্ষেপে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বস্তির মধ্যেই উপাচার্যের কর্মকান্ডে নতুন করে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। প্রকাশ্য আন্দোলন না থাকায় ভর্তি পরীক্ষা শেষে ক্লাস ও পরীক্ষা নতুন সময়সূচী নিয়ে কাজও শুরু করেছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ। তবে আবরার হত্যা, ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকা-সহ বুয়েট সঙ্কটের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের বক্তব্য নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সাধারণ শিক্ষকদের ক্ষোভের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে উপাচার্যের প্রতি রীতিমতো অনাস্থা জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি নতুন করে সামনে এনে শিক্ষক সমিতি বলেছে, বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে বর্তমান উপাচার্য অনুপযুক্ত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, উপাচার্যের শিক্ষক এমনকি ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে এবার শিক্ষকদের প্রকাশ্য আন্দোলন শুরু হতে পারে। তবে শিক্ষক ও উপাচার্য বিপরীতমুখী অবস্থান শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধের সুযোগকে নষ্ট করেছে বলেও মনে করেন সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্য আন্দোলন শেষ হওয়ার পর গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ও বুয়েট প্রশাসনের পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য দুদিন আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ভর্তি পরীক্ষা শেষে গত ১৫ অক্টোবর মাঠ পর্যায়ের আন্দোলন থেকে সরে আসেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে আবরার ফাহাদের খুনীদের বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেবেন না বলেও তখন জানিয়ে দেন তারা। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্য আন্দোলন না করলেও তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন চলছে। এই সময়ে পূর্ব নির্ধারিত সকল পরীক্ষার নতুন তারিখ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আস্তে আস্তে ক্লাস ও পরীক্ষায় ফেরার ইঙ্গিত দেয়। শীঘ্রই তারা ক্লাসে ফিরতে পারে বলেও জানানো হচ্ছিল। এক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির নিজস্ব আন্দোলনের কোন কর্মসূচীও ছিল না। কিন্তু গত এক সপ্তাহে উপাচার্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে সকল ব্যর্থতার জন্য শিক্ষকদের দায়ী করে বক্তব্য দিলে শান্ত পরিস্থিতি আবার অস্থির হতে থাকে। জানা গেছে, উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়ে, বুয়েটের আজকের পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক, শিক্ষক সমিতি ও ছাত্র কল্যাণ (ডিএসডাব্লিউ) পরিচালককে দোষারোপ করেছেন। এমনকি কিছুদিন আগে নিজেদের পছন্দের লোক না হওয়ায় বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক বদলাতে প্রশাসনকে বাধ্য করে বলেও অভিযোগ করেন বুয়েটের উপাচার্য। উপাচার্য দাবি করেন, আবরার হত্যাকা-ের ঘটনার দায় তার নয়। তার মতে ভিসির একার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু দেখভাল করা সম্ভব নয়। উপাচার্য বলেন, আমি উপাচার্য হিসেবে যোগদানের আগে থেকেই ক্যাম্পাসে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন ছিল। এর আগে ছাত্রকল্যাণ পরিষদ পরিচালক হিসেবে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অত্যধিক কাজের চাপ এবং ‘স্বাস্থ্যগত কারণ’ দেখিয়ে তিনি অবসরে গেছেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তিনি হলগুলোতে র‌্যাগিং থামাতে পারেননি। চলতি বছরের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত বার্ষিক পর্যালোচনা কমিটির সভায় র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে পারি আমি। উপাচার্য আরও বলেন, পরে অন্য এক সভায় অধ্যাপক সত্য প্রসাদ ছাত্র কল্যাণ পরিষদ পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। পরবর্তীতে বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিষদ পরিচালক পদে অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে ছাত্রলীগের তীব্র বিরোধিতার কারণে অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়াকেও অবিলম্বে পদ ছাড়তে হয়। অধ্যাপক কাশেমের স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক মিজানুর রহমান। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর আমি দেখতে পেলাম যে, অধ্যাপক মিজানও ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ছাত্র কল্যাণ পরিষদ যদি ঠিকভাবে কাজ করত তাহলে এ ধরনের ঘটনা কখনই ঘটত না বলেও দাবি উপাচার্যের। উপাচার্য গণমাধ্যমে আরও বলেছেন, ছাত্র কল্যাণ পরিষদ পরিচালক নিয়োগ ইস্যুতে ছাত্রলীগকে মদদ দেন শিক্ষকরা, বুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা। আমি দায়িত্বে থাকতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এর আগে বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে হাইকোর্টের আদেশে তারা বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করতে সক্ষম হয়। আমার কোন দায় নেই এমন মন্তব্য করে উপাচার্য বলেছেন, ‘আমার দোষ কোথায়? বরং আমি আমার অবস্থান থেকে পরস্থিতি সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু শিক্ষক সমিতির নেতারা শিক্ষার্থীদের এখনও মদদ দিচ্ছেন আমাকে সরানোর জন্য’। আগের দুই ভিসির সময়ের তুলনায় আমি অনেক শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। শুধু এই দুইজনকে (বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। ওরা কাশেম মিয়াকে ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালকের পদ থেকে সরানোর জন্য পাঁচ দিন স্ট্রাইক করেছিল। পুরো বিশ্ববিদালয়ে তালা মেরে দিয়েছিল। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে ছিল। তখন শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সাহায্য নিয়ে আমাকে সে সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। চলমান আন্দোলনে সক্রিয় অনেক শিক্ষার্থীই বলছেন, উপাচার্য সঠিক তথ্য দেননি। অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার ছিলেন বুয়েটের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র কল্যাণ পরিচালক। অথচ অবৈধভাবে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন উপাচার্য। তাকে সরিয়ে নিজের পছন্দের অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়াকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অথচ এ শিক্ষক আগে থেকেই বুয়েছে বিতর্কিত। তার অপসারণের জন্য সাধারণ শিক্ষকরাই তখন আন্দোলন করেছিলেন। উপাচার্য ওই আন্দোলনে ছাত্রলীগকে দায়ী করে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনিকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। এখন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কথা বলে উপাচার্য মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ উপাচার্য বিতর্কিত সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম মিয়ার পক্ষে এখনও কথা বলছেন। যা বুয়েটে অসন্তোষ বাড়ার একটি কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রাহাত বলছিলেন, আমরা সরকার ও প্রশাসনের কাজে খুশি হয়েই প্রকাশ্য আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। ইতোমধ্যেই ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে। আমরা কয়েক দফা আলোচনা করেছি নিজেদের মধ্যে। শীঘ্রই ক্লাস ও পরীক্ষায় ফেরার চিন্তাও চলছে। তবে উপাচার্য স্যার যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে শিক্ষকদের যে কোন অবস্থানের দিকেই থাকবেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন হলেও সে আন্দোলনে আমরা যোগ দিতে পারি। শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরলেও উপাচার্য পদত্যাগ না করলে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরবেন না- এমন ঘোষণাও দেয়া হতে পারে। উপাচার্যের অপসারণের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছেন শিক্ষক নেতারা। এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যাকা- ইস্যুতে উপাচার্য তার দুর্বলতা ও ভুল বুঝতে অক্ষম বলে মন্তব্য করেছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। এক বিজ্ঞপ্তিতে বুয়েট শিক্ষক সমিতি জানিয়েছে, বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম সাক্ষাতকারে বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দরা দায়ী করেছেন। যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার ও শিক্ষকদের জন্য চরম মানহানিকর। তার এই মিথ্যাচারে শিক্ষক সমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতবাক। কার্যনির্বাহী পরিষদ তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে ও অবিলম্বে এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। সমিতি বলেছে, উপাচার্যের বক্তব্য সরকার ও শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মতো একটি ষড়যন্ত্র। আবরার হত্যাকা-ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন ও সমগ্র দেশবাসীর প্রতিক্রিয়ার পরও উপাচার্য তার দুর্বলতা ও ভুল বুঝতে অক্ষম। যা বুয়েটের জন্য চরম হতাশাজনক। এছাড়াও তার আমলে যে দুজন শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন তা ঘোরতর মিথ্যা। মিথ্যাচারের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয় যে, বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে বর্তমান উপাচার্য অনুপযুক্ত। এছাড়া শিক্ষক সমিতি ইতোমধ্যেই উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে শিক্ষকদের অনাস্থার কথা জানিয়েছে। উপাচার্যের পদত্যাগের কথাও তুলেছেন তারা। তবে উপাচার্য বলেছেন, তিনি দায়িত্ব থেকে সরবেন না। বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি আমাদের আগেই ছিল। সেই অবস্থান এখনও আছে। আমরা বিবৃতির মাধ্যমে অবস্থান জানিয়েছি। দেখা করেও উপাচার্যকে বলেছি। তবে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি নন। এক প্রশ্নের জবাবে সভাপতি বলেছেন, উপাচার্য যেভাবে শিক্ষকদের দায়ী করে কথা বলছেন। যেভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তাতে শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আমরা তাই বলেছি, বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে বর্তমান উপাচার্য অনুপযুক্ত। সকালের মতো আমরাও মনে করছি বুয়েট পরিস্থিতি যে শান্ত হচ্ছিল উপাচার্যের কর্মকা-ের কারণে সেই অবস্থাটা নষ্ট হলো। এক প্রশ্নের জবাবে সভাপতি বলেন, আমরা তাকে তার অবস্থানের সমালোচনা করলেও তিনি দাবি করেছেন গণমাধ্যমে তিনি শিক্ষকদের দায়ী করে কথা বলেননি। গণমাধ্যম ভুল লিখেছে। গণমাধ্যমে প্রতিবাদ জানাবেন বলেও আমাদের তখন বলেছিলেন। তবে আজ পর্যন্ত তিনি প্রতিবাদও জানাননি। এদিকে সোমবার উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেলফোনে চেষ্টা করেও সারা পাওয়া সম্ভব হয়নি।
×